আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে “আইনগত সহায়তা আইন”
আধুনিক সভ্যতার অন্যতম মূল ভিত্তি মানবাধিকার যা কিনা সমঅধিকার নীতির ভিতে দাড়িয়ে রয়েছে এবং এর উপর নির্ভর করেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিটি মানুষের সুধু মানুষ হবার করনেই স্থান কাল পাত্র ভেদে রয়েছে নিজস্ব কিছু অধিকার যা সরকার তথা রাষ্ট্র তাকে প্রদান করতে বাধ্য। তাই বলা হয়ে থাকে আইন সবার জন্য সমান, আর এই সমঅধিকার প্রয়োগ করতে মানুষ আসে আইন – আদালতের দ্বার প্রান্তে কিন্তু প্রশ্ন হল আসলে রাষ্ট্র তথা সরকার কি বিচার ক্ষেত্রে এই সমান অধিকার দিতে বাধ্য যদি বাধ্য হয় তবে কি তা দিতে সেই সমঅধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে? পারলে কিভাবে? বাস্তবতা কি বলে এবং বর্তমানে কিভাবেই বা সরকার তার সেই প্রচেষ্টা করছে। আসুন আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি।
সংবিধানের ভিত্তিতে:
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে জনগণের সমান অধিকারকে নিশ্চিত কর হয়ে হয়েছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সমান অধিকারের কথা যাতে করে প্রতিটি নাগরিক সমান ভাবে সুযোগ সুবিধা পায় সাথে সাথে অনুচ্ছেদ ১৯(২) এ পিছিয়ে পরা জনগণের পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নেবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল:
- অনুচ্ছেদ, ২৭: আইনের চোখে সমান অধিকার; অর্থাৎ প্রতিটি মানুষকে আইন সমান সুযোগ ও সুবিধা প্রদান করবে এবং আইন দ্বারা রক্ষা করবে। ধনী-গরীব, ক্ষমতাবান বা সাধারণের ভিতর কোন ধরনের বৈষম্য করবে না।
- অনুচ্ছেদ, ২৮: ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ বা জন্ম স্থানের কারণে কেউ বৈষম্যের স্বীকার হবে না।
- অনুচ্ছেদ, ৩১: প্রতিটি মানুষ আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।
- অনুচ্ছেদ, ৩২: কোন মানুষ তার জীবন বা স্বাধীনতার থেকে বঞ্চিত হবে না।
আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে
এসব অধীকারসূমহ সারা বিশ্বেই বিভিন্ন সংবিধান, দেশিও আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা রক্ষিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য, সার্বজনীন মানবাধিকারের (১৯৪৮) অনুচ্ছেদ ৭, যেখানে প্রতিটি মানুষের সমঅধিকার এবং আইনের দ্বারা সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে “নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর), ১৯৬৬” তে এই অধিকারকে আরও বিশেষ ভাবে নজর দিয়ে বলা হয়েছে, গরিব দূ:খি মানুষের জন্য আইনি সুরক্ষা প্রদানের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ তহবিল গঠন করবে। অনুচ্ছেদ ১৪(৩)(ডি) তে আরো বলা হয়েছে, এমনকি যদি কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির যদি যথাযথ আর্থিক সামর্থ্য না থাকে তবে ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাকে রাষ্ট্র থেকে আইনি সহায়তা দিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে
এবার যদি আমার আইনগত সহায়তা আইন হবার প্রাককালে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দেখি আমারা দেখবে উপরে উল্লেখিত নীতিগুলো আমাদের বেশ কিছু আইন সাধারণ ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে কিন্তু তা বিশেষ ভাবে সুরক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির (১৮৯৮) ৩৪০ (১) ধারায় আমরা লক্ষ করি, এখানে বলা হয়েছে কোন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবী দ্বারা তার অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। আবার দেওয়ানি কার্যবিধির (১৯০৮) আদেশে ৩৩ এ নি:স্ব ব্যক্তি আদালতের ফি মৌকুফ করা হয়েছে।
বাস্তব চিত্র:
যদিও সংবিধান ও আইনগুলোতে মানুষের আইনের সমতার ও অধিকার রক্ষার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তবুও বাস্তবতায় দেখায় যায় মানুষ নানান আর্থি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে যথা যথ ভাবে আইনের দ্বারস্থ হতে পারছেনা অথবা আইনের দ্বারস্থ হয়েও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেউ কেউ অর্থের অভাবে মামলা করতে পারছেন না বা মামলা চালাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কেউবা ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ সামাজিক অবস্থার করনে সাহস করে এগুতে পারছেন না। এমন অবস্থায় যখন দেশের এই উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী আইন থেকে দুরে সরে যায় তখন দেশের সামগ্রিক আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর একটি নীতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং দেশের প্রশাসনিক তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থা নষ্ট হতে থাকে।
আইনগত সহায়তার ধারনা ও উত্থান:
মানুষের অসহায়ত্ব ও আইন থেকে দুরে সরে যাওয় সুধু আমাদের সমাজে নয় বরং পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই একটি বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়। তাই ১৯৫০ থেকেই কিছু জনকল্যাণ রাষ্ট্রে (welfare state) গরীব, অসহায় ও দুস্থদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকতো এবং এই ধারনা ক্রমন্বেয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে, যদিও এর আগেই বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থা এই সেবা দিয়ে নজির সৃষ্টি করে। তেমনি ভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সংস্থা আইনগত সহায়তা আইন হবার পূর্বেই কিছু সংস্থা ও এনজিও বিনামূল্যে আইন সহায়তার দেওয়া শুরু করে। এরমধ্যে অন্যতম পথ প্রদর্শক হচ্ছে মাদারীপুর লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ) যারা স্বাধীনতা পরবর্তীতেই এই আইনি সাহায্য দেওয়া সুরু করে। পরবর্তিতে ব্রাক, আসক, ব্লাস্ট বিশেষ ভাবে অবদান রাখে এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখে।
বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ এবং ফল
অন্যদিকে সরকার দেশে আইন ও বিচার পক্রিয়ার সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দায়বদ্ধতার দিকে খেয়াল রেখে দেশের প্রান্তিক জনগণের জন্য বিশেষ আইন “আইনগত সহায়তা প্রদান আইন,২০০০” প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে এই আইনকে সম্পূর্ণ করতে “আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪” ও ২০১৫ সালে “আইনগত সহায়তা প্রদান প্রণিধান ২০১৫” প্রণয়ন করে। সাথে সাথে এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০২ এর ৮(গ) ধারায়, পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০০৮ এর ৪ ধারায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২র ৩৪(২) ধারা বিশেষ ভাবে আইনি সহায়তার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছ। এই আইনের মাধ্যমে সরকারী ভাবে আইনগত সহায়তা সংস্থা গঠিত হয় এবং সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষে প্রান্তিক পর্যায়ে (জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে) তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। এবং এরই মাধ্যমে আইনগত সহায়তা আইন এবং তার অধীনে (সরকারি) আইনগত সহায়তা সংস্থা একটি পূর্নঙ্গ রূপ ধারণ করে। বর্তমানে হাজারো মানুষই এই আইনের সহায়তায় আইনি সহায়তা পাচ্ছেন। আমাদের পরবর্তী লেখায় বাস্তবিক প্রয়োগ ও সাহায্য গ্রহণ করারা উপায় সহ থাকবে বিস্তারিত।(লেখাটি পেতে এই লিংকে ক্লিক করুন)