ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য কি ও এর গুরুত্ব
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা Geographical Indications সংক্ষেপে জিআই (GI) হচ্ছে মেধাসম্পদের (Intellectual Property) অন্যতম শাখা। চলুন এটা কি তা একটু বুঝে নেই।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য কি ও কেন ?
দেখাযায় কোন নির্দিষ্ট স্থানের কোন পণ্য খুব নামকরা হয়ে থাকে এবং সবাই সেই নামের উপর বিশ্বাস করেই সেই পণ্য কিনে এবং ব্যবহার / ভোগ করে, যেমন ধরুন বগুড়ার দই, ঢাকাই জামদানী, বিক্রমপুরের মিষ্টি ইত্যাদি। এখানে লক্ষ করুন প্রতিটি পণ্যের সাথে তার স্থানের নাম যুক্ত আছে এবং এই নামটির একাধিক গুরুত্ব আছে।
একটু উদাহরণ দিয়ে বুঝাই, ধরুন এই যে বগুড়ার দই তারা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় যুগের পর যুগ তৈরি করে এসেছে যা অন্যদের থেকে আলাদা যার ফলে এর সুখ্যাতি হয়েছে, আবার ধরুন ঢাকাই জামদানি তৈরির জন্য এক সময় শুধু ঢাকাই কারিগররাই উৎপাদন করতে পারতো আর ঢাকার আবহাওয়াও এই জামদানি তৈরির জন্য দরকার ছিল ফলে তারা কষ্ট করে এগুলো যুগের পর যুগ করে এসেছে এবং এর ফলে এই পণ্যে পৃথিবী জুড়ে নাম হয়েছে।
তাই এই পণ্যগুলোর সাথে ভৌগোলিক সম্পর্ক ও মেধার অবদান দুই-ই প্রয়োজন হয়, যার ফলে এই মেধা সংরক্ষণের জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা Geographical Indications (GI) নামের মেধা সত্ত্বের স্বীকৃতি প্রয়োজন হয়। নয়তো দেখা যাবে অন্য কেউ একই পণ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সহজেই তৈরি করে ফেলছে কিন্তু তার মান ও গুন ঠিক এক নয়, অন্যদিকে যারা কষ্ট করে এই পণ্যগুলোকে বিখ্যাত করেছে তাদের কোন লাভ হবে না।
তাই আন্তর্জাতিক ভাবে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য স্বীকৃত এবং এর সত্ত্ব সংরক্ষিত তাছাড়া এ বিষয়ে আমাদের নিজস্ব আইনও রয়েছে।
ভৌগোলিক নির্দেশক পন্যের স্বীকৃত ও আইন
বাংলাদেশের আইন
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ এর ২(৯) ধারা অনুযায়ী, কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সাধারণ কথায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য একটি দেশের মালিকানা বা মেধাস্বত্ব হলো ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই)। সম্প্রতি, দেশের তৃতীয় জি আই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ‘খিরসাপাত’ জাতের আম নাম নিবন্ধনসহ এর সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সনদ তুলে দেওয়ার কাজ শেষ করেছে শিল্প অধিদপ্তর। নিবন্ধন পাওয়াতে এখন সুস্বাদু জাতের এই আম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম’ নামে বাংলাদেশসহ বিশ্ব বাজারে পরিচিতি লাভ করবে। এর আগে বাংলাদেশ আরো যে দুটি পণ্যের জি আই স্বীকৃতি পেয়েছে তা হলো যথাক্রমে জামদানি ও ইলিশ মাছ।
আন্তর্জাতি আইন
TRIPS (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। এই চুক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী হলেও দীর্ঘ সময় ধরে জি আই আইন না থাকায় এ দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মালিকানা সুরক্ষার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ ও ভৌগোলিক পণ্য নির্দেশক বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়নের পর বাংলাদেশের জি আই পণ্য স্বীকৃতি পাওয়ার পথ সুগম হয়।
আমাদের যথেষ্ট সচেতনতা ও উপযুক্ত আইনের অভাবে জামদানি, নকশী কাঁথা, ফজলি আম সহ প্রায় ৬৬ টি পণ্যের জি আই নিয়ে নিয়েছে ভারত। এমনকি বাদ যায়নি আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও। অনতিবিলম্বে সরকারের উচিত আমাদের জি আই পণ্যগুলো চিহ্নিত করা ও তা নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা। যেমন: সুন্দরবনের মধু, বগুড়ার দধি, কুমিল্লার রসমালাই ও খাঁদি ইত্যাদি।
জিআই নিবন্ধনের পদ্ধতি
ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (WTO) এর নিয়ম অনুযায়ী কোনো পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশকের (জিআই)নিবন্ধন পেতে হলে, ওই পণ্য যে দেশের সীমানা বা ভূখণ্ডে উদ্ভব বা তৈরি হয়েছে, তার ঐতিহাসিক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে হয়। জিআই নিবন্ধন দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ওই প্রমাণপত্রসহ একটি প্রবন্ধ তাদের নিজস্ব জার্নালে প্রকাশ করতে হয়। জার্নালে প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে অন্য কোনো দেশের প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যদি ওই তথ্যের ব্যাপারে আপত্তি তোলা না হয় বা অন্য কোনো সংস্থা ওই পণ্যের নিবন্ধনের দাবি না তোলে, তাহলে যে দেশ প্রবন্ধ প্রকাশ করে জিআই নিবন্ধন চেয়েছে, তা সেই দেশের নামে পণ্যটি নিবন্ধিত হয়ে থাকে। তবে, একই পণ্য অন্য একাধিক দেশ উৎপাদন করলে যে দেশ পণ্যটি সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করবে এবং পণ্যটি যে দেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হবে, সে দেশই ওই পণ্যের স্বত্ব পেতে অগ্রাধিকার পাবে।
জিআই নিবন্ধন পেলে সুবিধা
জিআই পণ্য হিসেবে যেসব পণ্যের নিবন্ধন কোনো দেশ পাবেন তারা যেসকল সুবিধা পাবেন তাহলো:
- সংশ্লিষ্ট পণ্যের মালিক হবে সেই দেশ। ভৌগোলিক পরিচিতও পাবে সেই দেশ।
- তারা সেই পণ্যের ব্যবসায়িক মুনাফার সম্পূর্ণ অংশের মালিক হবেন।
- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব আর কোনো দেশ দাবি করতে পারবে না।
- পণ্যের আলাদা রেপুটেশন তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপাদনকারীরা পণ্যের জন্য ভালো দাম পান।
- দেশের মধ্যেও অন্য কোনো এলাকার জনগোষ্ঠী এ পণ্যের মালিকানা পাবে না।
জিআই সত্ত্ব ভঙ্গ করলে
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে বা মিথ্যা ভাবে ব্যবহার করলে ৬ মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৫০,০০০ থেকে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারবেন। ৩০ ধারা অনুযায়ী একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে প্রতারণামূলক-ভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ ভৌগোলিক নির্দেশক ব্যবহার করলে।
আরো দেখুন: Intellectual Property laws in Bangladesh