তালাক দেয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করার পদ্ধতি ও হিল্লা বিয়ে
তালাক কি?
তালাক শব্দের অর্থ ‘বিচ্ছিন্ন’, ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, পরস্পর মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমণ্ডিত জীবনযাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, পারস্পরিক সম্পর্ক যখন হয়ে যায় তিক্ত, বিষাক্ত, একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমনভাবে বিমুখ হয়ে যায় যে, তাদের শুভ মিলনের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ঠিক তখনই এই চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। ইসলামে বিবাহকে পবিত্র বন্ধন বলে ধরা হয় এবং এ বন্ধনকে ছিন্ন করা ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম কেবল অনন্যোপায় অবস্থায় তালাক বৈধ করেছে। অর্থাৎ, তালাক হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল কাজ।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে- ‘কোনো পুরুষ তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাহিলে তাহাকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যে কোনো পদ্ধতিতে ঘোষণার পরই তিনি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও উহার নকল দিবেন’ অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি।
তালাকের ঘটনা সাধারণত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনকষাকষি, রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটি ইত্যাদির ফলে ঘটে থাকে। আর রাগ যখন চরমে ওঠে তখন স্বামী তার অমোঘ অস্ত্র একবারে ছুঁড়ে দিয়ে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করতে চায়। ফলে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়- এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বায়েন দিলাম ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে বলার পরিণতি কি হবে তখন তা আর তার হুঁশে থাকে না। এভাবে অনেকেই রাগের মাথায় বা অন্য যে কোনো কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে থাকেন। পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে তালাক দেয়া স্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে সংসার করবেন তাও বুঝে উঠতে পারে না। আজ থাকছে কিভাবে তালাকের পর পুনরায় স্ত্রীকে বিবাহ করা যাবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত।
রাগের মাথায় ভুল সিদ্ধান্তে মানুষ যাতে বিপদে না পরে এবং এক সাথে তিন তালাক না দিতে পারে সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে শরিয়া আইন থেকে একটু সরে এসে বর্তামান মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে রাষ্ট্র কিছুটা পরিবর্তিত পদ্ধতি অনুসরণ করা বাধ্যমূলক করেছে।
তালাক প্রদানের বর্তমান নিয়ম:
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর স্বামী চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও তার নকল দেবেন। একই আইনের ৭(৪) ধারার বলা আছে, স্ত্রী হাতে চিঠি পৌঁছানোর পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান একটি সালিশি বৈঠক আয়োজন করবেন। এ বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য দম্পতিদের মধ্যে মীমাংসা করা। যদি শেষ পর্যন্ত মীমাংসা না হয় তবে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশের ৯০ দিন অতিবাহিত হলে তালাক নিজে থেকেই কার্যকর হয়ে যাবে। তবে উপধারা- ৫ অনুযায়ী, তালাক দেওয়ার সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন তাহলে সন্তান জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। আবার এই ৯০ দিনের মধ্যে যদি স্বামী ও স্ত্রী তাদের দাম্পত্য জীবন সুরু করে দেয় তবে সেই তালাক পক্রিয়া সেখানেই স্থগিত হয়ে যাবে।
তালাকের নোটিশের পর পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের অবস্থা হতে পারে। এক, তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তালাক কার্যকর হয়নি। অথবা দুই, তালাক কার্যকর হয়েছে।
তালাকের নোটিশ দেওয়ার পর যে, ৯০ দিন সময় থাকে সেই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী যদি চান যে তারা আবার সংসার জীবন শুরু করবেন তাহলে কোন আইনি বাঁধা নেই। স্বামী একটি আবেদনপত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে পুনরায় তালাক দেয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতো সংসার করতে পারবেন। আর যদি তালাক কার্যকরের পর, স্বামী-স্ত্রী আবার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চান তাহলে তারা নতুন করে বিয়ে করে নিলেই হবে। একটি নতুন সাধারণ বিয়ে যেভাবে হয় সেভাবে বিয়ে করে নিলেই হবে।
হিল্লা বিয়ে কি?
হিল্লা বিয়ে হল যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর পুনরায় বিয়ে করতে চায় তখন সেই স্ত্রীকে অন্য কোন ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়ে ও দাম্পত্য জীবন সম্পন্ন করে তারপর তার থেকে তালাক নিয় পুনরায় আগের স্বামী সাথে বিয়ে দেওয়।
হিল্লা বিয়ের নিয়ম কেন ছিল?
যদিও এ নিয়ে অনেক বিতর্ক ও মতামত আছে তবে বলা হয়ে থাকে আরব দেশে পুরুষরা স্ত্রীদের যখন তখন তালাক দিত এবং পরে আবার ইচ্ছে করে বিয়ে করে ব্যবহার করেতে চাইতো এমন অবস্থায় এ অবস্থার ফলে স্ত্রীরা স্বামীর সঙ্গেও বসবাস করতে পারতো না। আবার অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো না। তাই হিল্লে বিয়ের মাধ্যমে এই অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় যাতে করে তালাক দেওয়া পরে যদি কারো বিয়ে হয় এবং সে যদি তালাক না দেয় তবে আর তাকে বিয়ে করা যাবে না।
সুরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতে আয়াতে বলা হয়েছে, “যদি তিন তালাক দেয়া হয়; তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দেয়ার পর পুনরায় সে স্ত্রীকে বিয়ে করার কামনা করে; তবে করণীয় কী? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর স্বামী যদি স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দেয় তবে অন্য লোকের সাথে বিবাহ দেয়া ব্যতীত সেই স্ত্রী (প্রথম) স্বামীর জন্য হালাল নয়।”
তবে বর্তমানে বাংলাদেশে হিল্লা বিয়ে সম্পুর্ণ বেআইনি কাজ ও আইনত দন্ডনীয়।
ইসলামিক আঙ্গিকে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে এই দুইটি লিংক দেখতে পারেন।
আইন হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে যা বলে:
১৯৬১ সালের পূর্বে বাংলাদেশেও এ নিয়ম (হিল্লা বিয়ের) ছিল যে, তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে তবে তা শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি এই যে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে শরিয়া অনুসরণ পূর্বক যথাযথভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং নতুন স্বামী তালাক প্রদানের পর আগের স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ দ্বারা উক্ত শর্তটি রহিত করে দেওয়া হয়েছে । অর্থাৎ তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী যদি পুনরায় একত্রে থাকতে চায় তবে তাদের নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে শরিয়া অনুসরণ পূর্বক যথাযথভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে না।
বর্তমানে , মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(৫) ধারা অনুযায়ী, কোন আইনই স্ত্রীকে একই স্বামীকে, যার সাথে তালাক হয়েছে, বিয়ে করা থেকে বিরত করবে না। তবে তিনবার এমন কাজ করা যাবে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ তিনবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে একই স্বামী বিয়ে করতে পারবেন। তবে, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে বিয়ে করলেও নতুন এই বিয়েও বিবাহ রেজিস্টারের অফিসে রেজিস্টার করা লাগবে।
এ অবস্থায় বলা যায় বর্তমানে নিজের তালাক প্রদান করা স্ত্রীকে বিয়ে করতে কোন বাধা বা অসুবিধা নেই ।
পূনরায় কাবিনের বৈধতা কতোটুকু
বিয়ে যতবার করবেন কাবিন ততবার দিতে হবে।
স্ত্রীকে তালাকের পর দ্বিতীয়বার বিয়ের ক্ষেত্রে শুধু সাধারন বিয়ের মত বিয়ে করলেই হবে? নাকি স্ট্যাম্পে ভুল বোঝাবুঝি বিষয়ক কোনো লিখিত মন্তব্য লিখে নোটারী করতে হবে???
আইনে পূনরায় কিছু লিখতে হবে বলে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক-ই-তৌফিজ দেয় তাহলে ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই তাদের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেলে তারা কি পুনরায় সংসার করতে পারবে?
৯০ দিন হবার আগে তালাক কার্যকর হয় না। তাই পুনরায় সংসার করতে পারবে এতে সমস্যা নেই।