মুসলিম স্ত্রীর দ্বারা তালাক ও আইন
মুসলিম (ব্যক্তিগত) আইনে বিয়ে হচ্ছে একটি চুক্তি আর এই চুক্তি কোন একপক্ষ বা দুই পক্ষ মিলে ভঙ্গ করা যায় এই (বিয়ের) চুক্তি ভঙ্গই হচ্ছে তালাক বা বাংলায় বিবাহ বিচ্ছেদ । তথা স্বামী বা স্ত্রী বা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মতামতে ভিত্তিতে বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে দায়মুক্ত হাওয়া যায়। ইসলামে তালাককে নিকৃষ্টতম হালাল কাজ বলা হয়েছে।
মুসলিম স্ত্রী কি তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ দিতে পারে। ইসলামী শরিয়ায় স্বামীদের তালাক দেওয়ার একছত্র অধিকার দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ স্বামী যখন খুশি কোন কারণে বা কারন ছাড়া তার স্ত্রীদের তালাক দেয়ার অধিকার রাখে যা স্ত্রীদের দেয়া হয়নি। তবে, শরিয়া মোতাবেক কিছু শর্ত পূরণ করে ইসলামী শরিয়ার ভেতরে থেকেই স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার পেতে পারেন, আবার বর্তমানে আইনের সাহায্য নিয়েও একজন মুসলিম স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে।
বিভিন্ন ভাবে তালাক দেয়ার পদ্ধতি:
১. ইসলামিক নিয়ম মেনে সুধু স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাকঃ
ক. তালাক-ই-তৌফিজ এর মাধ্যমেঃ
এটি হচ্ছে অর্পিত ক্ষমতাবলে দেয়া তালাক। এই ধরনের তালাকে স্বামী কিছু শর্তসাপেক্ষে তার তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্ত্রীকে প্রদান করে এবং উক্ত শর্ত অনুযায়ী স্ত্রী তালাক প্রদান করতে পারবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিবাহ রেজিস্ট্রির তথা কাবিননামার ১৮ নাম্বার কলামে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষমতা অর্পণ করার কথা লেখাই থাকে স্বামী সাধারণত সেটায় টিক দিয়ে মেনে নিয়ে (অর্থাৎ স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করেই বিয়ে করে থাকেন) এবং সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এই প্রদত্ত ক্ষমতার বলে যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাকে ‘তালাক-ই-তৌফিজ’ বলে। এক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এও উল্লেখ্য যে কাবিনের কোন শর্ত ভঙ্গ হলেও যেমন কাবিনের টাকা সঠিক ভাবে পরিশোধ না করলেও স্ত্রী স্বামীকে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে তালাক দিতে পারবেন। (স্ফুরা খাতুন বনাম ওসমান গনি মোল্লা ১৯৫৭, ৯ ডি.এল.আর ৪৫৫)
খ. খুলা-র মাধ্যমেঃ
প্রচলিত হানাফি আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম স্ত্রী শুধু খুলা তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে। যদি কোনো কারণে কোনো স্ত্রী মনে করেন যে তাঁর হক নষ্ট হচ্ছে অথবা তাঁর ওপর জুলুম করা হচ্ছে অথবা ব্যক্তিগত কোনো কারণে এখানে সংসার করতে চাচ্ছেন না, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর জন্য জায়েজ আছে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ‘খুলা’ করতে পারবেন। খুলাও এক প্রকার তালাকই। কিন্তু সেটা হচ্ছে, স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া, মুক্ত করে নেওয়া। খুলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল প্রস্তাবটি আসতে হবে স্ত্রীর কাছ থেকে এবং স্ত্রীকে প্রয়োজনে তার কোন স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও (যেমন সম্পত্তি বা দাবি ত্যাগ করে হলেও তার তার স্বামীকে এই তালাকে রাজি করাতে হবে) এবং কেবলমাত্র তখন-ই তালাক হবে। তবে মজার ব্যাপার হল যদি স্বামী কোন ভাবে/ যৌক্তিক ভাবে রাজি না হন তবে আদালতও তার আদেশের মাধ্যমে খুলা (তালাকের) আদেশ দিতে পারবেন। (বিলকিস ফাতিমা বনাম নাজমুল একরাম কোরেশী ১৯৫৯, ১১ ডি.এল.আর ৯৩)
স্ত্রীর দ্বারা তালাক ও আইন
২. স্বামী-স্ত্রী দুজনের আলোচনার ভিত্তিতে।
মুবারাতের মাধ্যমেঃ
স্বামী-স্ত্রী দুজনই মুবারাতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেনঃ মুবারাত হলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় উভয়ই বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয় বলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না। শরিয়া অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট ১৯৩৭ এই তালাকের বিধান ছিল। মুবারাত তালাকের প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে।
৩. শরিয়ার বাইরে আইনের আশ্রয়ে স্ত্রীর তালাক পাওয়ার অধিকার।
স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেনঃ উপরিউক্ত কোন পদ্ধতিতে তালাক কার্যকর না হলেও স্ত্রী ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারেন। এ আইনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে। কারণগুলো হলো:
- ১. চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
- ২. দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে।
- ৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারা দণ্ড হলে।
- ৪. স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
- ৫. বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
- ৬. স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে।
- ৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটির ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে।
- ৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
- ৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
একজন মুসলিম স্ত্রী উপরের যে কোন এক বা একাধিক কারণে পারিবারিক আদালতের নিকট The Family Court Ordinance, 1985 এর ৫ ধারা অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন।
আদালতে উপরিউক্ত অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। চেয়ারম্যান উক্ত নোটিসকে তালাক সংক্রান্ত নোটিস হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হবে।
তালাক পরবর্তী করনীয়:
তালাক যেভাবেই কার্যকর হোক না কেন পক্ষগনকে কিছু পক্রিয়া অনুসরণ করে তালাকটি পূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করতে হয়।
নোটিশ পাঠানোঃ
বিবাহ বিচ্ছেদের বা তালাকের ঘোষণা মাত্রই তালা হয় যায় না সে হোক স্বামী বা স্ত্রীর দ্বারা বা আদালতের আদেশ দ্বারা। চূড়ান্ত ভাবে বিচ্ছেদ সফল করতে হলে তা চেয়ারম্যান বরাবর জানাতে হবে। আদালত দ্বারা বিচ্ছেদের রায় হলে তা নিয়ে চেয়ারম্যান বরারবর প্রদান করতে হবে। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হলো, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে যে নোটিশ তাকে দেয়া হয় তা পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে কমপক্ষে তিনবার উভয় পক্ষকে ডেকে সালিশ পরিষদের মাধ্যমে সালিশের ব্যবস্থা করা। এর পরেও দুই পক্ষই তালাকের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক সফল ভাবে সম্পন্ন হবে।
প্রসঙ্গত, এ অধ্যাদেশে পারিবারিক বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সালিসী কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং প্রতিযোগী পক্ষগণের মধ্য থেকে একজন করে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিনিধি সমন্বয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে। পৌর এলাকায় পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এলাকায় কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক সালিসী কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
তালাক রেজিস্ট্রেশনঃ
‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন ১৯৭৪’ অনুসারে বিয়ের মত তালাকেও রেজিস্ট্রিশন করতে হয়। নিকাহ নিবন্ধক অর্থাৎ কাজি তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকার মধ্যে আবেদনপত্রের ভিত্তিতে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন। আইনানুসারে, যে ব্যক্তি তালাক কার্যকর করেছেন তিনি রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন করবেন এবং ফি দেবেন। নিকাহ্ নিবন্ধক পরীক্ষা করে দেখবেন উক্ত দু’পক্ষের মধ্যে সত্যি তালাক কার্যকর হয়েছিল কিনা। সাধারণত স্বামীস্ত্রী উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব হলো, নিকাহ্ নিবন্ধন ও তালাক রেজিস্ট্রির প্রত্যয়ন কপি তুলে নেয়া এবং সংরক্ষণে রাখা। যদি নিকাহ্ রেজিস্ট্রার কোনো তালাক রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান, তবে সেই ক্ষেত্রে উক্ত রেজিস্ট্রিকরণের নিমিত্ত দরখাস্ত করেছিল এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সেরকম অস্বীকৃতির ৩০ দিনের ভেতর জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল দায়ের করতে পারেন ও ঐরূপ আপিলের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত আদেশই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।
সালিশ পরিষদ, তালাকের নোটিশ, তালাকের নিবন্ধন সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটি দেখুণ : তালাক দেয়ার সঠিক নিয়ম
তাছাড়া এই ভিডিওটিও দেখতে পারেন;
স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে কি তালাক দেওয়া যায় কি?
হ্যা যায় তবে গর্ভবতী অবস্থায় তালাক দিলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হবে৷ অর্থাৎ স্ত্রী গর্ভবতী হলে, সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
স্ত্রী তালাক দিলে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে যে তাহলে স্ত্রী কি দেনমোহর পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর সহ দেনমোহরের বিস্তারিত জানতে দেখুন: দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান
লেখাটি যৌথভাবে লিখেছেন রায়হানুল ইসলাম এবং অপরাজিতা দেবনাথ।