বিবাহিত পুরুষ ও দেনমোহরের বাস্তবতা
বাংলাদেশী আইনে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারিবারিক বিষয়গুলো তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যেমন; উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের মূল ভিত্তি হল ধর্মীয় বিধান। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিঞ্চিৎ সংশোধন করে Statute বা বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করেছে। এই ধর্মীয় আইনের অন্যতম অনুষঙ্গ- দেনমোহরের অপব্যবহারে পুরুষ নির্যাতন, পুরুষের জীবন দুর্বিষহ করা ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব ।
দেনমোহর কি ও কেন?
ইসলামী শরীয়াহ আইনে বিবাহের অন্যতম মৌলিক শর্ত হল স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা। দেনমোহর হল কিছু সম্পদ বা টাকা যা বিবাহের শর্তস্বরূপ স্ত্রীকে absolutely প্রদান করতে হয়। অবশ্য অর্থ বা সম্পদ প্রদানে অপারগ হয়ে হাদিসে কুরান শিক্ষাকে দেনমোহর হিসেবে ধরে বিবাহের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। সূরা আন নিসার আয়াত নং ৪ এবং ২৪ এ স্বামীদের প্রতি খুশি মনে স্ত্রীকে নির্ধারিত দেনমোহর প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদিসে আরও বলা হয়েছে যে স্বামীর দেনমোহর প্রদানের ইচ্ছা নেই, সে ব্যভিচারী (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩)। অর্থাৎ পাপী।
দেনমোহর কি যৌতুকের সমতুল্য?
অনেকে দেনমোহরকে স্বামীর উপর এক প্রকার যৌতুক হিসেবে সাব্যস্ত করতে চান। কিন্তু শরীয়াহ, রাষ্ট্রীয় আইন এবং প্রথা অনুযায়ী দেনমোহর এবং যৌতুক এক নয়। যৌতুক নিরোধ আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, “…যৌতুক অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত হওয়া কোন সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত।
- (ক) বিবাহের এক পক্ষের দ্বারা বিবাহের অপর পক্ষের প্রতি, অথবা
- (খ) বিবাহের সময় বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোন সময় উক্ত পক্ষগণের বিবাহের প্রতিদান হিসাবে বিবাহের যে কোন পক্ষের মাতা-পিতা দ্বারা বা অপর কোন ব্যক্তির প্রতি, কিন্তু যে ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়ত) প্রযোজ্য তাহাদের ক্ষেত্রে যৌতুক বা মোহর অন্তর্ভুক্ত করে না।”
এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ২(ঞ) -এ যৌতুকের অনুরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তবে এই ধারায় কণে পক্ষ কর্তৃক বর পক্ষের থেকে দাবীকৃত অর্থ বা সামগ্রীকে যৌতুকের সংজ্ঞায় আনা হয়নি। তাই এই দুই আইনের দুইটি ধারা মিলিয়ে পড়তে হবে। তাহলে দাঁড়ায়, স্বামী বা স্ত্রী যেকোনো পক্ষের দাবীকৃত অর্থ বা সামগ্রীকে যৌতুক বলা যায়।
দেনমোহরের প্রকারভেদ
পরিশোধের সময়ের উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দুই প্রকার। যথা;
- Prompt বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর যা স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বে বা স্ত্রী যখন তলব করবে, তখনই পরিশোধ করতে হবে, এবং
- Deferred বা বিলম্বিত দেনমোহর যা দুটি পরিস্থিতিতে প্রদানে বাধ্য থাকতে হয়।
- যদি স্বামীর মৃত্যু হয় বা অন্যভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক ভঙ্গ হয়ে যায়; অথবা,
- যদি স্বামী সালিসি পরিষদের পূর্বানুমতি ব্যতীত বা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে পরবর্তী বিবাহ করেন। (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ধারা- ৬(৫)(ক)) এ অধ্যাদেশের ১০ ধারায় বলা হয়েছে কাবিননামায় বা বিবাহের চুক্তিতে দেনমোহর তাৎক্ষণিক নাকি বিলম্বিত এমন কিছু উল্লেখ না থাকলে ধরে নিতে হবে তা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। অর্থাৎ স্ত্রী তলব করা মাত্রই শোধ করতে হবে।
বাংলাদেশী মুসলিমদের অধিকাংশ বিবাহে বিলম্বিত দেনমোহর ধার্য করা হয়ে থাকে। তালাকের সাথে Deferred বা বিলম্বিত দেনমোহরের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী স্বামী কোন কারণ ছাড়াই ইচ্ছানুযায়ী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী কোন অবস্থাতেই নিজে নিজে তালাক দিতে পারেন না। তিনি স্বামীর কাছে তালাক চাইতে পারেন বা স্বামীর ত্রুটির সুনির্দিষ্ট ৯-১০ টি কারণসহ বিচারকের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন।
কারণগুলো হল:
- ১) স্বামীর অন্তত ৪ বছর ধরে নিখোঁজ থাকা,
- ২) ২ বছর ধরে ভরণপোষণ না দিতে পারা,
- ৩) স্ত্রীর পূর্বানুমতি ব্যতীত স্বামীর অন্য বিবাহ করা,
- ৪) অন্তত ৭ বছর কারাদণ্ডভোগ,
- ৫) পুরুষত্বহীনতা,
- ৬) অন্তত ২ বছর যাবৎ স্বামীর মানসিক রোগ বা কুষ্ঠ রোগ বা মারাত্মক যৌন রোগে ভুগা,
- ৭) ১৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তাহাকে তাহার পিতা বা অন্য কোন অভিভাবক বিবাহ দিয়াছেন এবং ১৯ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি উক্ত বিবাহ নাকচ করিয়াছেন। তবে শর্ত থাকে যে, বিবাহ যৌন মিলন হয় নাই।
- ৮) স্ত্রীর সাথে স্বামীর নিষ্ঠুর আচরণ।
- এছাড়াও মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলিয়া স্বীকৃত অন্য কোন কারণে। (ধারা ২, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯)
স্বামী যেমন স্ত্রীকে কোন কারণ ছাড়াই তালাক দিতে পারেন, স্ত্রী কখনোই এমনটা পারেন না। তবে কাবিননামার ১৮ নং কলামে বিবাহের সময় স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকলে অর্পিত ক্ষমতাবলে স্ত্রী নিজে নিজে তালাক দিতে পারেন। এটাকে তালাকুল তাফিউজ বলে। অন্যথায় পারিবারিক আদালতে তালাকের আবেদন করতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না, স্ত্রী ডিভোর্স দিলেও স্বামী দেনমোহর প্রদানে বাধ্য। অবশ্য স্ত্রী মওকুফ করলে ভিন্ন কথা।
আমাদের সমাজে খামখেয়ালি কিছু পুরুষ আছেন। স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি দায়িত্বহীন কিছু স্বামীও রয়েছেন, যাদের চাপে রেখে সামাজিক সুবিচার করতে হয়, পারিবারিক সম্পর্কে বেঁধে রাখতে হয়। সেজন্য এমন পুরুষ ও নারীর পরিবার ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সুচিন্তিত সম্মতিতে উচ্চ দেনমোহরের চাপে বিবাহ টিকিয়ে রাখার জাস্টিফিকেশন সামান্য মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে বিবাহ টিকিয়ে রাখা বা বিচ্ছেদে লাভবান হবার জন্য বর্তমান সমাজে অধিকাংশ বিয়েতে পাত্রী পক্ষ Deferred Dower বা বিলম্বিত দেনমোহর দাবি করে থাকেন এবং পাত্রপক্ষ তাতে রাজি হন।
ব্যাপারটা এমন যে, দেনমোহর ধার্য করা হল, স্ত্রী সেটা আদায় করবে না, স্বামীকে কখনো পরিশোধ করতেও হবে না। কেবলমাত্র যদি কখনো তালাক দিতে হয়, তখন পরিশোধ করতে হবে। তালাক দিতে হবে এমনটা বিয়ের সময় কোন ছেলে ভাবে কি? কাজেই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাজি হয়ে যায়।
এছাড়া কোন কোন বিয়ের সময় দেনমোহর হিসেবে কিছু গহনাগাঁটি এবং নগদ টাকায় আংশিকভাবে শোধ করে বাকিটা বিলম্বিত হিসেবে রেখে দেয়া হয়। উপরন্তু যেকোনো প্রকার দেনমোহর আদালতের নির্দেশে বা স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতার ভিত্তিতে কিস্তিতে শোধ করা যেতে পারে।
আবার বিবাহের সময় “নির্ধারণ করা বা না করার” ভিত্তিতে দেনমোহর দুই প্রকার Specefied বা বিবাহের সময় নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত এবং Unspecified বা অনির্ধারিত যা পরবর্তীতে সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং আদায় করা যায়। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামী এবং স্ত্রীর পারস্পরিক যোগ্যতা, বয়স, গুণ, রূপ-সৌন্দর্য, ভার্জিনিটি, পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস, পরিবারের অন্যান্য নারীর বিবাহে ধার্য কৃত দেনমোহরের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনা করা যেতে পারে।
দেনমোহরের পরিমাণ কত হবে?
দেনমোহর হিসেবে যে কোন পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা যেতে পারে, তবে তা কোন অবস্থাতেই দশ দিরহামের কম হবে না। তবে, ১৮৭৬ সালে অযোধ্য আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে এমন দেনমোহর নির্ধারণ করতে হবে যা স্বামীর দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে অন্য এক কেইস লতে আমরা পাই, “ন্যায্য” দেনমোহর কত হবে তা স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন মেয়ের ফুফু, মা এদের ক্ষেত্রে কত ছিল তা বিবেচ্য হবে।
তবে যদি কোন কারণে বিয়ের সময় দেন মোহর ঠিক না হয়ে থাকে বা যথাযথ না হয়ে থাকে তবে পরে আদালত তা যথাযথ ভেবে নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
দেনমোহর আদায়ের উপায়
পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ৫ ধারার মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে (সহকারী জজ আদালতে [দেওয়ানী আদালত] ) দেনমোহরের মামলা করা যায় তবে এই মামলাটি ৩ বছরের মধ্যে করতে হবে। একজন উকিল নিয়োগ করে খুব সহজেই এই মামলা পরিচালনা করা যায়।
তবে অনেক সময় দেখা যায় একজন অবহেলিত নারীর জন্য এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করারও খুব কষ্টকর হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইডের (সরকারি) সহযোগিতা নেওয়া যতে পারে অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্ট (BLAST), BHRF, আসক, অধিকার, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (BNWLA), BRAC ইত্যাদি NGO এর সহায়তা নিয়ে অসহায় মেয়েরা সহজেই দেনমোহর আদায় করে নিতে পারেন।
বাস্তব চিত্র
তাত্ত্বিক আলোচনা হল। এবার কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
- ঘটনা ১:
চুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার একটা বেসরকারি চাকরিতে জয়েন করলেন। কিছুদিন পর ১৫ লক্ষ টাকা “বিলম্বিত দেনমোহর” ধার্য করে এক সুন্দরী মেয়েকে বিবাহ করলেন। বিয়ের ২ সপ্তাহ পর স্ত্রী মায়ের বাসায় বেড়াতে গেল। সেখানে যাবার পর মেয়ে পক্ষ স্বামীকে তালাক দিতে বললেন অন্যথায় নারী নির্যাতনের মামলা করবেন বলে হুমকি দিলেন। তালাক চাইবার কারণ মেয়ের মা তার পছন্দের পাত্রের সাথে মেয়েকে বিবাহ দিতে চান এবং এ পর্যায়ে মেয়েটি মায়ের কথায় রাজি। ফ্রেসার একজন ইঞ্জিনিয়ার ১৫ লক্ষ টাকা কই পাবেন? ধার-দেনা করে, লোণ তুলে নিঃস্ব হয়ে মাত্র ২ সপ্তাহের দাম্পত্য জীবন শেষে দুই মাসের মাথায় স্ত্রীকে ১৫ লক্ষ টাকা শোধ পূর্বক তালাক দিতে বাধ্য হলেন। উনি আমার সাথে কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন। আইনের প্রতি তার তিক্ত অনুভূতি জানিয়েছেন ।
ভেতরের ঘটনা যাইহোক, আন্ডার ৩০ বয়সী ফ্রেসার চাকরিজীবী ছেলের ১৫ লাখ টাকা ম্যানেজ করতে গিয়ে এই যে ঋণে জর্জরিত হতে হল, এই ক্ষত উনি কত বছরে পূরণ করবেন? আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত হয়ে এখন তার পরবর্তীতে বিবাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। ২ সপ্তাহের দাম্পত্য জীবনে মেয়েটির ইনকাম ১৫ লাখ টাকা (?) এছাড়াও বিয়ের খরচের একটা উচ্চ একাউন্ট আছে। ভদ্রলোক আমাকে জোর দিয়ে বলেছিলেন উনি কোন নির্যাতন করেন নি, উনার কোন দোষ ছিল না।
- ঘটনা ২
কলেজ পড়ুয়া এক ছেলে সহপাঠীর প্রেমে হাবুডুবু খেল। এদিকে মেয়ের পরিবার মেয়ের অন্যত্র বিয়ে ঠিক করল। মেয়ে তো আবেগে ছেলেকে বলে দিল, এক জীবনে সে শুধু তাকেই চায়। তাকে না পেলে আত্মহত্যা করবে। ছেলেটাও মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। অনেক ভালবাসে যে! সুতরাং তারা পালালো। এদিকে মানসম্মানের ভয়ে দু পরিবার তাদের মেনে নিল। মেয়ের পরিবারের শর্তে বিবাহ হল, দেনমোহর ২০ লাখ। ছেলের পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত। এখন ছেলেটা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। আর মেয়েটা ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে এলাকার একটা সরকারি কলেজে অনার্স ভর্তি হয়ে বাবার বাড়িতে থাকতে লাগলো। ছেলেটা এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফেসবুকের যুগে মেয়েটা ওদিকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন চাকরিজীবী ছেলেদের সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখতে শুরু করল৷ মেয়েটার এখন আর এই বেকার স্বামীকে ভাল লাগছে না। এ পর্যায়ে তার বোধোদয় (!) হল – ছাত্র স্বামী কবে পড়াশোনা শেষ করবে, আর কবেই’বা চাকরি পাবে, আবার কি চাকরি পাবে তাও অনিশ্চিত। এইসব বলে ছেলেটাকে কষ্ট দিতে লাগলো। ভার্সিটির ছুটিতে ছেলেটা বাসায় গেল। স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দেবে। রুমে ঢুকলো। স্ত্রীর মোবাইলে মুভি চলছে, সাথে ডেটা অন, স্ত্রী ওয়াশরুমে গেছে। মোবাইলে মেসেজ আসছে, শব্দ হচ্ছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছেলেটার অজ্ঞান হবার দশা। অন্য পুরুষকে সে নিজের নগ্ন ছবি সেন্ড করেছে, সেক্স চ্যাটিং করেছে, এমনকি অসংখ্যবার শারীরিক সম্পর্কও করেছে। এ অবস্থায় এমন স্ত্রীকে মেনে নেয়া যেকোনো ছেলের পক্ষে কঠিন ব্যাপার।
কিছুতেই সে স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছে না। তার কথা মনে আসলেই ঘৃণা এবং আফসোসে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিত্রাণের উপায় হল তালাক দেয়া। কিন্তু বিধিবাম দেনমোহর ২০ লাখ!
মেয়ে বলছে, দাও দাও তালাক দাও। কত বড় মুরোদ তোমার দেখি। “২০ লাখ টাকা দেনমোহর শোধ করে তালাক দাও, নইলে আমাকে নিয়ে যাও, নইলে নারী নির্যাতনের মামলা খাও।”- মেয়ের এবং তার পরিবারের অভিব্যক্তি। ২০ লাখ টাকা ম্যানেজ করা ভার্সিটিতে পড়া একটা সাধারণ ছাত্রের পক্ষে সম্ভব?
এদিকে ধার্যকৃত দেনমোহরের পরিমাণ কমানোর এখতিয়ার স্ত্রী ভিন্ন আর কারোর নেই। ছেলেটাও অপারগ। দেনমোহর শোধ করতে পারবে না। আবার স্ত্রীকেও মেনে নিতে পারবে না। কাজেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ থাকে আত্মহত্যা??? ছেলেটা এখন মাঝেমাঝে এমন উপায় ভেবে বসছে। ধর্মমতে সেটাও মহাপাপ, আবার নিজের জীবনের মূল্য আছে, বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে। ছেলেটা এখন জীবন্ত লাশ হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
- ঘটনা ৩
বাবা-মা জোর করে তাদের পছন্দের পাত্রের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দেনমোহর ৮ লাখ টাকা। কয়েক মাস পর মেয়েটা স্বামীকে ডিভোর্স দিল। অজুহাত তার BF এই স্বামীর থেকে থেকে হাজার গুণ ভাল ছিল। এই স্বামীকে পেয়ে উনার প্রত্যাশা মেলেনি। এই স্বামীকেও অহেতুক এত বড় আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হল।
দুশ্চরিত্র হওয়া বা আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে, কিংবা স্ত্রীর খেয়ালিপনার তালাকে উচ্চ দেনমোহর শোধ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অজস্র পুরুষ। কিংবা দেনমোহর শোধ করতে না পেরে জীবন্ত লাশ হয়ে তার সাথে সংসার করা লাগছে। এমনকি স্ত্রীর কথা না শুনলে নারী নির্যাতনের মামলায় ভুগা লাগছে।
আপনাদের ডাক্তার আকাশের কথা মনে আছে? উনি মেডিকেলের শিক্ষক ছিলেন। উনার স্ত্রী পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন, মোবাইলে স্ত্রী এবং তার পরকীয়া প্রেমিকের অশ্লীল আলাপন এবং অন্যান্য প্রমাণ দেখে উনি শরীরে বিষ ইনজেক্ট করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কারণ জানিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। অথচ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিল। দেনমোহর ছিল উচ্চ মানের(?)
বিবাহে অনেক মেয়ের বক্তব্য থাকে এমন,”আমি এ টাকা কখনোই নেব না। তোমার দেয়া লাগবে নাকি! জাস্ট আমার প্রেস্টিজ বাড়বে, সবাইকে বলতে পারব। ইত্যাদি।” ছেলেটাও সরলভাবে চিন্তা করেন ছাড়ার জন্য তো বিয়ে করছেন না। কাগজে যেকোনো একাউন্ট লিখে রাখলে সমস্যা কি!
সমাধান
সমস্যাটি যেহেতু খুব বাস্তব এবং সমাজে যেহেতু এর প্রভাব ব্যাপক তাই সমাধানটিও হতে হবে আইন আর বাস্তবতার সমন্বয়ে। আমি আইনের ছাত্র হিসেবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছু সমাধান দেয়ার চেষ্টা করলাম যা আপনারা বিবেচনা করতে পারেন। তবে কোন কাজ করার আগে বা আইনি পরামর্শ নেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বিজ্ঞ আইনজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন।
আমার মতে একজন পুরুষের ৩ থেকে ৬ মাসের স্বাভাবিক ইনকামের সমপরিমাণ দেনমোহর ধার্য করা উচিৎ। ৩০-৩২ বছরের জীবিকার জীবনে ঊর্ধ্বে গেলেও ১ বছরের ইনকাম দেয়া যেতে পারে। অথবা নগদে যা সাধ্যে কুলায়, তাই দেয়া উচিৎ।
- প্রথমত, আবেগে পড়ে বা নিজের ক্লাস মেনটেইন করার জন্য বা অতিরিক্ত ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করা উচিৎ হবে না।
- দ্বিতীয়ত, কোন কারণে উচ্চ দেনমোহর ধার্য হয়ে গেলে তালাকের সময় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আত্মীয় স্বজনের চাপে একটা যৌক্তিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আদালত দেনমোহর কমানোর ক্ষমতা রাখে না। পারিবারিক বা সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে যদি কিছু পারেন, করেন। অবশ্য দেনমোহরের পরিমাণ বেশি হলে তালাকের সময় অনেক ক্ষেত্রে আদালতে ডিফেন্স দেয়া হয় এভাবে মিথ্যা বলে, “স্ত্রী বা তার পরিবার জালিয়াতি করে বা প্রতারণা করে এমাউন্ট বেশি করেছে। বিয়ের সময় মুখে কম বলেছিল, লেখার সময় বাড়িয়েছে। ইত্যাদি।” এগুলো প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার।
- তৃতীয়ত, বিয়ের সময় আবেগে না ভেসে “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” কোন সম্পর্ক ধ্রুব নয়। আজ যে প্রিয়তমা, কাল সে তা নাও থাকতে পারে হয়তো সেই আপনার চরম শত্রু হয়ে যাবে। এই বিষয়টা মাথায় রেখে তবেই বিয়ে করা উচিৎ।
বিবাহ হোক সুখের জন্য, অসুখী বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন সার্থকতা নেই। বিবাহ এবং ডিভোর্স উভয়ই অত্যন্ত সহজ হোক। কারোর সাথে সুখী থাকলে সে তো তাকে ডিভোর্স দেবে না, তাইনা?
নারীর উচ্চ দেনমোহর কতটা যৌক্তিক?
দেনমোহর প্রথার আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতার জন্য। পুরুষের ইনকামের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া তখন নারীদের জীবন ধারণ সহজ হত না। উপরন্তু মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রপার্টি পান। সেই পরিস্থিতিতে নারীদের প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ দেনমোহরের প্রচলন হয়। এখন শিক্ষিত নারীরা সহজেই ইনকাম করতে পারছে। যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সমতা চাওয়া হচ্ছে, তখন এইরকম উচ্চ দেনমোহর চেয়ে নারীরা কেন আমার ভাইদের জীবনে অহেতুক চাপ সৃষ্টি করছেন?
একটা উদাহাণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। মনে করেন, ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন পাওয়া পাত্র এবং একই গ্রেডে বেতন পাওয়া পাত্রীর বিবাহ হল। দুজনেরই ইনকাম সমান। এখন স্বামী স্ত্রীকে কেন উচ্চ দেনমোহর দেবে? নারী কি এখানে পুরুষের ভোগ্য পণ্য? এক্ষেত্রে স্ত্রীকে স্বামীর ইনকামের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না। উল্টো ভরণপোষণ ও দেনমোহরের নামে পুরুষটির উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেখানে বরং সংসারে নারী ও পুরুষের সমান কন্ট্রিবিউশন থাকা উচিৎ এবং দেনমোহর হওয়া উচিৎ ন্যূনতম।
আমাদের প্রিয় নবীর জীবনীতেও দেখবেন যে তিনি যখন খাদিজা (রা:) [খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ] কে বিয়ে করেন তখন খাদিজা (রা:) এই সমতা মেনে সংসারে ও ইসলামের জন্য তার সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু পুরুষ নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায় এবং কিছু নারী তাদের সম্পদ জমিয়ে রাখতে চায় যা ঠিক সমঅধিকারের বিপরীত। যারা নারী-পুরুষের সমতা চান, তাদের বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ।
অন্যদিকে যারা মনে করেন, নারীদের আয় করা উচিৎ না, গৃহিনী হয়ে থাকা উচিৎ, সেক্ষেত্রে সেই মেয়ের জন্য উচ্চ দেনমোহর নির্ধারণ করা যেতে পারে।
হাদিসে দেনমোহরের ব্যাপারে নির্দেশনা আছে যেন সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করা না হয়।
অস্বাভাবিক দেনমোহর ধার্য করা হয়ে থাকলে কোন পক্ষের আবেদন ক্রমে সেটা পুনঃ নির্ধারনের ক্ষমতা বিচারকের হাতে ন্যস্ত করার জন্য সময়োপযোগী বাস্তব-ধর্মী আইনি বিধান করা উচিৎ।
পরিশেষে কামনা করি, জীবন হোক সুন্দর। নারী পুরুষ কেউ কারোর খেলনা না হোক। না হোক ভোগ্য পণ্য। শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতির সুযোগের সমতার যুগে নারী আত্ম পরিচয়ে বলীয়ান হোক। সবাই সমঅধিকারের ভিত্তিতে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলুক।
এ বিষয়ে আরো দেখতে পারেন: দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান