প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনী অধিকার
জাতীয় উন্নয়নে দেশের সকল নাগরিকের সম-অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নাগরিকদেরও রয়েছে উন্নয়নের ও অংশগ্রহণ এর সম্পূর্ণ অধিকার। প্রতিটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু আমাদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের কারণে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই কম। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’’।
সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’’। উল্লেখিত ২টি অনুচ্ছেদ ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো কিছু অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অন্যান্য ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। এভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে।
এছাড়াও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ United Nations Convention on the Rights of the Persons with Disabilities অনুসমর্থন (Ratification) করেছে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ২০০১ সালের ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন’ টি রহিত করে ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩‘ প্রণীত হয়।
প্রতিবন্ধি ব্যক্তি
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতা বলতে বোঝায়, দেহের কোন অংশ বা তন্ত্র যদি আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ী ভাবে তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায় সেই অবস্থা।
ধারা ৩ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধিতার ধরনসমূহ হইবে নিম্নরূপ, যথা:
- (ক) অটিজম
- (খ) শারীরিক প্রতিবন্ধিতা
- (গ) মানসিক অসুস্থতা জনিত প্রতিবন্ধিতা
- (ঘ) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা
- (ঙ) বাকপ্রতিবন্ধিতা
- (চ) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা
- (ছ) শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা
- (জ) শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা
- (ঝ) সেরিব্রাল পালসি
- (ঞ) ডাউন সিনড্রোম
- (ট) বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং
- (ঠ) অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা ।
প্রতিবন্ধিদের অধিকার
ধারা ১৬ অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতার ধরণ ভেদে প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিম্ন বর্ণিত ২১ টি অধিকার থাকিবে, যথাঃ
- (ক) পূর্ণমাত্রায় বাঁচিয়া থাকা ও বিকশিত হওয়া;
- (খ) সর্বক্ষেত্রে সমান আইনী স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা;
- (গ) উত্তরাধিকার প্রাপ্তি;
- (ঘ) স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্য প্রাপ্তি;
- (ঙ) মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সহিত সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন;
- (চ) প্রবেশগম্যতা;
- (ছ) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকর ভাবে অংশগ্রহণ;
- (জ) শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ;
- (ঝ) সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি;
- (ঞ) কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকিবার, অন্যথায়, যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি;
- (ট) নিপীড়ন হইতে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধা প্রাপ্তি;
- (ঠ) প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি;
- (ড) শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র সহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ সুবিধা’ (reasonable accommodation) প্রাপ্তি;
- (ঢ) শারীরিক, মানসিক ও কারিগরী সক্ষমতা অর্জন করিয়া সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে একীভূত হইবার লক্ষ্যে সহায়ক সেবা ও পুনর্বাসন সুবিধা প্রাপ্তি;
- (ণ) মাতা-পিতা বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে বা তাহার আবাসন ও ভরণ-পোষণের যথাযথ সংস্থান না হইলে, যথাসম্ভব, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন;
- (ত) সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ;
- (থ) শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণ;
- (দ) ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা;
- (ধ) স্ব-সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতি গঠন ও পরিচালনা;
- (ন) জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ; এবং
- (প) সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন অধিকার।
বৈষম্য করা যাবে না
এছাড়া উপধারা ২ এ বলা হয়েছে, কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উল্লিখিত অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোন প্রকারের বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্য মূলক আচরণ করতে পারবে না।
সংরক্ষিত অধীকার
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে, সকল গণপরিবহনে মোট আসন সংখ্যার শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখা [ধারা ৩২]; শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উক্ত ব্যক্তির, অন্যান্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবেন না [ধারা ৩৩] ইতাদি।
তাছাড়া, ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বজনীনগম্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ বিধানে উল্লেখ আছে- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত সহজ করার জন্য ঢালুপথ/র্যাম্প তৈরি করতে হবে, এবং প্রতি তলায় ন্যুনতম একটি টয়লেট অথবা সার্বিক টয়লেট সংখ্যার ৫%(যাহা অধিক)পরিমাণ টয়লেট প্রতিবন্ধী সুলভ করতে হবে ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ভঙ্গ করলে শাস্তি
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উল্লেখিত অধিকারগুলো ভঙ্গ করলে অথবা অধিকার ভোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে শাস্তির বিধান রয়েছে ধারা ৩৭ এ। যেমনঃ
(১) কোন ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনের আশ্রয় লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(২) কোন ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রাপ্য হিস্যা হইতে বঞ্চিত করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(৩) কোন ব্যক্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন সম্পদ আত্মসাৎ করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(৪) কোন ব্যক্তি পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোন প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা প্রদান বা নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার বা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(৫) কোন ব্যক্তি অসত্য বা ভিত্তিহীন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসাবে নিবন্ধিত হইলে বা পরিচয়পত্র গ্রহণ করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ১ (এক) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(৬) কোন ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয়পত্র তৈরী করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৭ (সাত) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
কমিটি সূমহ
এই বিষয়গুলো দেখ-ভাল, নিতি-নির্ধারন তথা পরিচালনা করার জন্য এই আইনের অধীনে রয়েছে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটির, জেলা কমিটি, এবং উপজেলা বা শহর কমিটি। যারা সময়ে সময়ে সরকারের কাছে তথ্য প্রেরন করবেন, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন ও সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাবেন। এবং এজন্য প্রতি বছর জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যূন দু্ইটি সভা, জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যূন তিনটি সভা, জেলা কমিটির অন্যূন চারটি সভা এবং উপজেলা বা শহর কমিটির অন্যূন ছয়টি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিবন্ধি সনদ
কোন ব্যক্তিকে এই আইনের অধীনে প্রতিবন্ধিদের সকল সূযোগ সুবিধা পেতে হলে তাকে অবস্যই প্রতিবন্ধি হতে হবে এবং তার একটি প্রতিবন্ধি সনদ থাকতে হবে।
প্রতিবন্ধি সনদের জন্য আবেদন
উপজেলা, জেলা বা শহর কমিটির সভাপতির কাছে প্রতিবন্ধি সনদের জন্য আবেদন করা যাবে। এই আবেদন সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা সরকারি হাসপাতালের দায়িত্ব প্রাপ্ত চিকিৎসকের প্রত্যায়নপত্রসহ করতে হবে এবং প্রতিবন্ধি ব্যক্তি নিজে বা তার তার মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনানুগ অভিভাবক এই আবেদন করতে পারবেন।
উল্লেখ্য এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা যাবে না এবং একান্তই করলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে জেলা কমিটির নিকট আপিল করতে পারবেন। যদি প্রত্যাখিত না হয় বা আপিলে ফল প্রতিবন্ধি ব্যক্তির পক্ষে হয় তবে তিনি প্রতিবন্ধি হিসেবে নিবন্ধিত হবেন এবং একটি পরিচয় পত্র পাবেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রতিবন্ধিদের জন্য সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% লোক কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী৷বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১ কোটি ৭০ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে একটি রাষ্ট্রের উন্নতি, অগ্রগতি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ সৃষ্টিতে এবং উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে প্রয়োজন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, এবং সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা।