বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন, সেই সাথে এটি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সকল ধর্মেই বিবাহ নিয়ে আলোচনা রয়েছে আর প্রায় প্রতিটি ধর্মেই বিবাহ ভিত্তিক আলোচনার মূল বক্তব্য হচ্ছে বিবাহের দুই পক্ষ অর্থাৎ পুরুষ এবং নারী দুইজনকে অবশ্যই একই ধর্মের হতে হবে। মুসলিম,হিন্দু,খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ প্রায় সব ধর্মেই একই রীতি যে, বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজ ধর্মের অনুসারে কাউকে বিয়ে করতে হবে। তবে, ইসলাম ধর্মে মুসলিম পুরুষরা চাইলে, অমুসলিম কিন্তু কিতাবিয়া নারীকে বিয়ে করতে পারবে, যদিও মুসলিম নারী কোন অমুসলিম বা কিতাবিয়া পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না। এছাড়া, বাকী সকল ধর্মের ক্ষেত্রে তারা কেবল নিজ নিজ ধর্মের লোককেই বিয়ে করতে পারবে। তবে বিভিন্ন ধর্মীয় রীতির বাইরেও বিয়ের বিধান রয়েছে, যা বিশেষ বিবাহ আইন নামে অভিহিত।
বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহের ধারণা
বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’ অনুযায়ী। একই ধর্মের নয়, অথচ বিয়ে করতে চায় এমন ব্যক্তিদের বিয়েকে আইনসম্মত করা এ আইনের উদ্দেশ্য। যে কোন ধর্মের লোকই “বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২” অনুযায়ী তার ভিন্ন যে কোন ধর্মের লোককে বিশেষ বিবাহ করতে পারবে। এমনকি যেসব ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাঁদের মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে। অর্থাৎ, যার কোন ধর্ম নাই, সেও এই আইনের অধীন বিবাহ করতে পারবে।
কারা বিশেষ বিবাহ করতে পারে?
ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, এ আইনের মাধ্যমে সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ে বৈধতা পেয়ে থাকে। আর সেজন্য যে ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ,শিখ বা জৈনএর কোন একটির অনুসারী কিন্তু সে নিজ ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায়, সে বিশেষ বিবাহ আইন,১৮৭২ এর অধীনে বিবাহ করতে পারবে।তবে এই আইনের অধীন বিবাহ করতে গেলে ধর্মহীন হয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান করতে হবে। বিশেষ বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে। (১৯৬৬) ১৮ ডিএলআর ৫০৯ মামলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ধার্য হয়েছে—তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন। আর এ আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাই, বিশেষ বিবাহ করতে দুই পক্ষকেই বাস্তবে প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ত্যাগ করতে হবে।
বাংলাদেশে কীভাবে বিশেষ বিবাহ সম্পন্ন হয়?
এই আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এজন্য নির্দিষ্ট রেজিস্টার বই আছে। নিজ ধর্ম বিশ্বাস বাদ দিয়ে যেসব নারী-পুরুষ বিবাহ করতে আগ্রহী তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি করতে সরকার রেজিস্টার নিযুক্ত করেন। বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করতে চাইলে পাত্র ও পাত্রীকে একজন আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে৷ আইনজীবীর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতকৃত হলফনামায় পাত্র-পাত্রী স্বাক্ষর দানের পর ওই হলফনামা নোটারি পাবলিক কর্তৃক নোটরাইজড করতে হবে ৷ হলফনামায় অবশ্যই ‘বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে’ শব্দগুচ্ছ লিখতে হবে ৷ অতঃপর সরকার অনুমোদিত বিশেষ বিবাহ রেজিস্টারের কাছে নির্ধারিত ফরম পূরণ পূর্বক ৩ জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয় ৷ বিয়ে সম্পাদনের পর রেজিস্টার ‘বিবাহ প্রত্যয়ন বই’য়ে প্রত্যয়নপত্র অন্তর্ভুক্ত করবেন, যা নির্ধারিত একটি ফরম। এবং এটি উভয় পক্ষ ও তিনজন সাক্ষী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হবে। রেজিস্টার সরকার-নির্ধারিত ফরমে ‘বিবাহ প্রত্যয়ন বই’য়ে লিপিবদ্ধ সব অন্তর্ভুক্তির অনুলিপি তাঁর জেলার ‘জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের রেজিস্টার জেনারেল’-এর কাছে পাঠাবেন।
আইনের অধীনে বিশেষ বিবাহ সম্পন্নের শর্তাবলী
এবারে জেনে নেয়া যাক, বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের শর্তাবলি, সম্পাদনের পদ্ধতি, কার দ্বারা এ বিয়ে সম্পাদন হবে, এ বিয়ের ফলে উত্তরাধিকার, সহ উত্তরাধিকার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী যা ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইনের বিভিন্ন ধারায় সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর ৪ ধারা অনুযায়ী, বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে যে কোনো একটি পক্ষ রেজিস্টারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবে। যদি এই ১৪ দিনের মধ্যে দুই পক্ষের কেউ কোন রকম আপত্তি না করে থাকে তবেই আইন অনুযায়ী এই বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে। মনে রাখতে হবে, বিশেষ বিবাহের ক্ষেত্রে এই নোটিশ অত্যন্ত জরুরী। সেই সাথে এই বিয়েতে সম্মতি অত্যন্ত জরুরী কেননা বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর অধীন বিয়ে একটি দেওয়ানী চুক্তি। এই আইনের ১১ ধারায় বলা আছে,বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্টার এবং ঘোষণাপত্রে সাক্ষ্যর দানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে।বিয়ের দুই পক্ষ রেজিস্টার ও তিনজন সাক্ষীর সামনে“আমি ‘ক’ কে আইনত স্ত্রী/স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছি”- এই রকম ঘোষণা দেবে। ১১ ধারার এইসব বিধানাবলী ১৮ ডিএলআর (১৯৬৬) পাতা ৫০৯ মামলায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে, বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে অনুষ্ঠানের কিছু নির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে এবং আইনের ২ ধারা মোতাবেক শর্তাবলী নিম্নরূপ:
- (ক) বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারোই কোনও জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না
- (খ) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ অনুসারে পুরুষ ব্যক্তির বয়স ২১ বছর এবং মহিলার বয়স ১৮বছর পূর্ণ হতে হবে,
- (গ) পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবেন না, যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে৷
হিন্দু,বৌদ্ধ,শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বীর কেউ এই আইনের অধীনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের সম্পত্তির এবং এ বিয়ের ফলে তাদের জাত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার‘উত্তরাধিকার আইন,১৯২৫’ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। অপরদিকে আইনটির ২২ নং ধারা অনুসারে,সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর কতিপয় বিয়ের ফলাফল হিসেবে হিন্দু,বৌদ্ধ,শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো যৌথ পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইন মোতাবেক বিয়ে হলে অনুরূপ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে, এ বিয়ের জন্য ধর্ম ত্যাগ বাধ্যতামূলক আর তাই ধর্মত্যাগের সাথে সাথে যৌথ পরিবার থেকেও বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। একটি ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে বিশেষ বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা এই আইনের অধীনে সম্পন্ন হলেও বিবাহ বিচ্ছেদটা হয় অন্য আইনের অধীন।বিশেষ বিবাহ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে এই আইনের অধীনে বিয়ে করলে বিয়ে বিচ্ছেদের সময় ১৮৬৯ সালের“ডিভোর্স আইন” দ্বারা বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পাদন করতে হয়।
সর্বোপরি, যেসব ব্যক্তি খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন ধর্মের অনুসারী নয় এবং যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন ধর্মের অনুসারী তাদের কতিপয় বিয়ে সন্দেহ মুক্ত ও আইনসম্মত করার লক্ষ্যেই এ আইন করা হয়েছে।
আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন: ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে, বিশেষ বিবাহ আইন ও বাস্তবতা।