ডিক্রি, আদেশ এবং রায় কি ও এদের পার্থক্য – দে. কা. ০৩

হতেই পারে আপনি আইন আদালত বিষয়ে নতুন বা এখনো আইনের ছাত্র হিসেবে ঠিক পাকা হয়ে উঠতে পারেননি কিন্তু আপনি আছেন ঘোর কনফিউশনে আর কনফিউশনের বিষয় হোল দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি, আদেশ এবং রায় নিয়ে [Decree, Order and Judgment]। নিশ্চয়ই ভাবছেন এতগুলো কেন এবং এদের মধ্যে পার্থক্যই বা কি? আর আপিল, রিভিউ ও রিভিশনের কনফিউসনতো আছেই।

চলুন দেখা যাক, ডিক্রি, আদেশ এবং রায়ের বিস্তারিত, আপিল, রিভিউ ও রিভিশন ইত্যাদি।

 

ডিক্রি, আদেশ এবং রায়

ডিক্রি, আদেশ এবং রায়

১. ডিক্রি ও ২. আদেশ এই দুইটি বিষয় বুঝতে হলে আমাদের মোটামুটি রায় সম্পর্কে একটু ধরানা থাকতে হবে। তাই আমরা পুরো বিষয়টি একটু একনজরে দেখে নেই।

কোন বিষয় যখন আদালতের নিকট পেশ করা হয়, আদালত বিচার প্রক্রিয়া  শুরু করার আগে কিছু ব্যবস্থা নেন, যেমন: অভিযুক্ত পক্ষকে ডাকা, তাদের অভিযোগটি দেওয়া এবং তাদের মন্তব্য/ উত্তর নেওয়া, কোন কোন বিষয়টি বিচার করবে ইত্যাদি নির্ধারন করা। এরপর আসে মূল বিচার প্রক্রিয়া যেখানে সাক্ষ্য প্রমান নেওয়া হয় এবং সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে রায় ঘোসনা করে

আবার আদালত রায় ঘোসনা করার আগেই কোন প্রয়োজনে কিছু আদেশ প্রদান করতে পারে। ধরা যাক, রহিম একটি জমি দখল করে আছে, এখানে জমিটি করিমের বলে করিমের দাবি, তবে জমিটি কার সেই উত্তরে পৌছানোর আগেই আদালত রহিমকে জমিটি দখল মুক্ত করে দেওয়ার জন্য আদেশ দিল। এখানে  কারো মালিকানা সম্পর্কে কোন রায় আদালত ঘোসনা করেন নি তাই এই আদেশটি চূড়ান্ত ভাবে কারো অধীকার সম্পর্কে ঘোসনা দেয় না। এটি হচ্ছে একটি আদেশ [Order]

কিন্তু বিষয়টি একটু অন্য ভাবেও হতে পারে, যেমন ধরুন, আদালত সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে এই রায় দিল যে জমিটি করিমের তখন এটি একটি চূড়ান্ত ঘোসনা যা কোন করিমের অধিকার সম্পর্কে নিশ্চিত করে তাকে ঐ জমির অধিকারী করে, তাই এটি একটি ডিক্রি [Decree]। আদালত অধীকার ঘোসনার সাথে সাথে এই আদেশও দেয় যে রহিমকে জমিটি ছেড়ে দিতে হবে।

ভিডিও

রায় [Judgment]

এখানে আমরা একটি রায়ের মাধ্যমে দুটি বিষয়ই পেলাম ১. ডিক্রি ২. অর্ডার। রায়ে কেন ডিক্রিটি বা অর্ডারটি প্রদান করা হোল, কোন দলিলের বা সাক্ষ্যের বা আইনের ভিত্তিতে এসব ও উল্লেখ করেন যা পড়ে আমরা পুরো বিচার প্রক্রিয়াটা বুঝতে পারি, এই বাকি কথা গুলো সহ পুরো বিষয়টাকে বলে রায় বা Judgment. 

সজ্ঞায়ন: দেওয়ান কার্যবিধি ২(৯) ধারায় বলা হয়েছে,

ডিক্রি বা আদেশের কারন হিসেবে আদালত যে মন্তব্য করেন তাই হচ্ছে রায়।

  • মামলার শুনানি সমাপ্ত হবার পর সাথে সাথে অথবা ৭ দিনের মধ্যে আদালত রায় প্রাদান করবে। (আদেশ ২০, বিধি ১)

তাহলে আমরা বুঝলাম রায় আগে দেয় তারপর ডিক্রি এবং/বা অর্ডার দেয় (ধারা ৩৩) । এখন রায়ের আবার দুটি অংশ থাকে।

  1. Ratio Decidendi; যেখানে ডিক্রিটি কেন দেওয়া হল তা ব্যাখ্যা করা থাকে এবং নির্দেশনা থাকে যা যথাযথ কতৃপক্ষ মানতে বাধ্য।
  2. Obiter Dictum; এ অংশটুকু বিচারকের মতামত এবং গাইড লাইন এর মতন। এই অংশ কোন কতৃপক্ষ মানতে বাধ্য নন। তবে সাধারনত মানতে চেষ্টা করা হয়।

যদিও ডিক্রি ও অর্ডার প্রাথমিকভাবে বোঝা বেশ সহজ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কাজের সময় এগুলো বেশ এলোমেল মনে হয়, তখন কোনটি ডিক্রি এবং কোনটি অদেশ তা বোঝাটা একটু কষ্টসাধ্য বটে কিন্তু কাজের প্রয়োজনে যা খুবই গুরুত্বপূর্ন, তাই আমরা এখন ডিক্রি এবং আদেশের কিছু টেকনিকাল বিষয় জানবো:

 

ডিক্রি:

ধারা, ২(২) ডিক্রি [Decree]: কোন মোকদ্দমায় আদালতের আনুষ্ঠানিক ও চুড়ান্ত ফলাফল যার মাধ্যমে পক্ষগন তাদের বিবাদের বিষয়ে রায় পেয়ে থাকেন সেটি হল ডিক্রি। এর সাথে আরো দুই ধরনের সিদ্ধান্তও (আদেশ) ডিক্রি হয়ে থাকে।

১. আরজি প্রত্যাখ্যান: দেওয়ানি মামলায় কোন পক্ষ আদালতের নিকট বিচারের জন্য লিখিত যে দলিল পেশ করে তাই হোল আরজি, এখন আদালত আরজি গ্রহন না করে নানান কারনে তা প্রত্যাখ্যান/খারিজ/নাকজ করতে পারেন। এমন ভাবে আরজি প্রত্যাখ্যান হলে সেই প্রাত্যাখ্যানটি একটি ডিক্রি বলে ধরে নেওয়া হবে।

[ব্যতিক্রম: নি:শ্ব ব্যক্তির মামলা করার দরখাস্ত প্রত্যাখ্যান হলে তা ডিক্রি হবে না।]

নিচের চারটি কারনে আরজি নাকচ হবে

  • ১. আরজিতে মামলার কার উল্লেখ না থাকলে।
  • ২. আরজিতে প্রতিকার মূল্য কম দিলে এবং আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিল মূল্য লিখতে ব্যার্থ হলে।
  • ৩. কম মুল্যের স্টাম্প পেপারে আরজি দিলে এবং যথা সময়ের মধ্যে যাথাযথ ভাবে ষ্ট্যাম্প পেপার দিতে ব্যার্থ হলে।
  • ৪. মামলাটি যদি আইন অনুসারে বারিত (নিষিদ্ধ) হয়।

২. ধারা ১৪৪ অধীনে (প্রত্যার্পণ) আবেদন করা হলে: কোন পক্ষ আগে কোন সুবিধা পেয়েছিল বা ভাল অবস্থানে ছিল পরবর্তীতে কোন আদেশের বা ডিক্রি ফলে যদি সে সুবিধা / অবস্থান পরিবর্তন হয় তখন সেই ভুক্তভোগি পক্ষ ধারা ১৪৪ আর অধীনে প্রত্যার্পণ আবেদন করতে পারবেন। তখন ঐ আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত যে সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন তাও ডিক্রি হিসেবে বিবেচিত হবে।

 

এবার চলুন দেখি কিছু বিষয় যেগুলো ডিক্রি হবে না।

  1. আপিল করা যায় এমন অর্ডার [আদেশ]।
  2. কোন পক্ষের ভুলের / না করার কারনে (যেটা করা দায়িত্ব ছিল) যদি কোন আদেশ হয় সেই আদেশ।
  3. আদালতের নির্দেশ পালনে ব্যার্থ হলে মামলা খারিজ হলে তা ডিক্রি নয়।  [আদেশ ৯, বিধি ২,৩,৮ এবং আদেশ ৪১ বিধি ১১(২), ১৭, ১৮]। [3+4]
  4. কোন দেওয়ানি মামলা না হলে কোন ডিক্রি হবে না, তার মানে মোকদ্দমা ব্যতিত  শুধুমাত্র আবেদনের প্রেক্ষিতে কোন রেমেডি পেলে সেটা ডিক্রি হবে না।
  5. নি:শ্ব ব্যক্তির মামলা করার দরখাস্ত প্রত্যাখ্যান হলে তা ডিক্রি হবে না। [4+5]

ডিক্রির প্রকারভেদ:

ক. প্রাথমিক ডিক্রি: যে ডিক্রি দ্বারা বিরোধের বিষয়টির সম্পূর্ন মিমাংসা হয় না বরংচ প্রাথমিক ভাবে কিছু বিষয় সমাধান হয় সেটি হল প্রাথমিক ডিক্রি।
খ. চূড়ান্ত ডিক্রি: যে ডিক্রি দ্বারা বিরোধের বিষয়টির সম্পূর্ন মিমাংসা হয়  সেটি হল চূড়ান্ত ডিক্রি।

  • এছাড়াও আরো এক ধরনের ডিক্রি আছে যাবে বলে  সোলে ডিক্রি  এই ডিক্রি হল আপস মিমাংসার মাধ্যমে প্রাপ্ত ডিক্রি। [আদেশ ২৩, বিধি ১]

ডিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন; আপিল কখন করা যায় বা যায় না।

  • সাধারনত ভাবে আপিল করা যায়, কিন্তু নিচের অবস্থায় করা যায় না।
    • আপস মিমাংশার ডিক্রি।
    • এস আর আইনের ধারা ৯  ধারায় কোন ডিক্রি হলে কোন আপিল বা রিভিউ করা যাবে না।
    • স্মল কজেজ কোর্টের কোন ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না।

# কোন দ্বিতীয় আপিল করা যায় না
# এক পাক্ষিক ডিক্রির বিরূদ্ধে আপিল করা যায়।

আদেশ:

ধারা, ২(১৪) আদেশ [Order]: কোন মোকদ্দমায় আদালতের আনুষ্ঠানিক ও চুড়ান্ত ফলাফল ব্যতিত অন্য যে রায় দেওয়া হয় তাই আদেশ।

  • অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা একটি আদেশ
  • আবেদন [Application] এর মাধ্যমে যতগুলো সিদ্ধান্ত আসবে সেগুলো সব আদেশ।

আদেশ দুই প্রকারের:

  • ১. আপিল যোগ্য : বিশেষ ক্ষেত্রে আপিল যোগ্য।

ধারা ১০৪ মতে এবং আদেশ ৪৩ এর রুল ১ মতে [যেখানে ২৫টি অদেশের তালিকা দেওয় আছে] এগুলো পারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

  • ২. আপিল যোগ্য নয়: সাধারন ভাবে আপিল যোগ্য নয়।

# আর্জি ফেরত (Return, Order 7, rule 10) একটি আপিলেবল অর্ডার;

আর্জি ফেরত। [Return of plant] (কোন ভুলের কারনে)

  • যদি ভুল যায়গায় মামলা করা হয়
  • আর্থিক বা এলাকার এখতিয়ার যদি না হয়
  • তামাদি হলে

 

ডিক্রি, আদেশ এবং রায় নিয়ে আরো বিস্তারিত ইংরেজী আর্টিকেলটি দেখুন এখানে: Judgment, Decree & Order – CPC 01

আমাদের দেওয়ানী কার্যবিধি সিরিজের ১ম (এর আগের) লেখাটি দেখুন এখানে: দেওয়ানী কার্যবিধি কি ও কেন?

আমাদের দেওয়ানী কার্যবিধি সিরিজের ৩য় (এর পরের) লেখাটি দেখুন এখানে: মামলা স্থগিতকরণ ও দোবারা দোষ


এই পার্থক্যগুলো আরো বিস্তারিত এবং ছক আকারে দেখতে এই লিংকে গিয়ে আমাদের ইংরেজী লেখাটি দেখে আসতে পারেন।

আমাদের আপডেটেড নোট, গাইড, ভিডিও টিউটোরিয়াল পেতে এবং আইন বিষয়ক বিভিন্ন  ট্রেনিং, কোচিং, কোর্স কিনতে আমাদের  আইন পাঠশালা ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন। ২০২৩ সালের বার কাউন্সিল MCQ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আগ্রহী হলে দ্রুত আইন পাঠশালা ফেসবুক গ্রুপ এ সংযুক্ত হোন।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

3 Responses

  1. abdur rahman says:

    Nice

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!