Site icon আইন সেবা [ল হেল্প বিডি]

দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান

মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে করলেই একজন নারী তার স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী হয়ে থাকেন, কিন্তু কখন পাবেন, কতটা পাবেন, এবং কিভাবে পাবেন তা নির্ভর করে বিভিন্ন আইন কানুনের উপর। আজকাল বিয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা বেড়ে যাওয়াতে প্রথমেই দেনমোহর প্রসঙ্গটা চলে আসে এবং আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। বিয়ে করার আগে অবশ্যই আমাদের দেনমোহরের ব্যপারে পরিষ্কার ধারনা থাকতে হবে অন্যদিকে বিয়ের পরে দেনমোহর আদায় ও মামলা করার ব্যপারেও আমাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তাই এসব বিষয়ে এই লেখায় বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

 

দেনমোহর কি?

দেনমোহর বুঝতে হলে আগে এক কথায় বিবাহ কি তা আমাদের বুঝতে হবে নয়তো বিষয়টা বোধগম্য হবে না। ইসলামিক আইনে বিবাহ হচ্ছে একটি (দেওয়ানী) চুক্তি। প্রশ্ন হল চুক্তি কি? চুক্তি হল এক পক্ষ একটি জিনিস নেবে এবং তার বিপরীতে অন্য কিছু (সাধারণত অর্থ) দেবে। যেমন ধরুন, দোকান থেকে টিভি কিনে (নিয়ে) আমরা দোকানদারকে বিনিময় টাকা দিলাম।

দেনমোহর হল কোন বিবাহর পর একজন নারীর / স্ত্রীর বিবাহের মূল্য স্বরূপ পাওনা। দেনমোহর বিবাহ হওয়ার কোন পূর্ব শর্ত না কিন্তু বিবাহ হয়ে গেলে তখন দেনমোহর দিতেই হবে।

তার মানে, ইসলাম অনুযায়ী দেনমোহর বিয়ের আগেই দিতে হবে বা ছেলে দেন মোহর দেয়ার মত অবস্থা থাকতে হবে বা আগেই নির্ধারণ করতে হবে তা না, কিন্তু বর্তমান আইনে কাবিন / রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে আবার দেনমোহর ঠিক করতে হবে।

দেনমোহর বিষয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন ইসলামিক জুরিষ্ট এবং আমাদের আইন বিভাগের রায়ের মাধ্যমে বিষয়টাকে আরও পজেটিভলি ক্লিয়ার করা হয়েছে। আবদুল কাদের বনাম সালিমা কেইসে বলা হয়েছে দেনমোহরের বিষয়ে  মূল্য শব্দটি ঠিক চুক্তি আইনের ব্যবহৃত শব্দের অর্থে ব্যবহৃত হয় না বরং এটি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক একটি দায়িত্ব মাত্র। তাই এটিকে কখনই বিবাহের মূল্য বলা যাবে না।

দেনমোহরের শ্রেণী বিভাগ

পরিশোধের সময়ের উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দুই প্রকার। যথা;

সাধারণত বিয়ের সময় দেনমোহরের  একটি অংশকে তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং বাকি অংশকে বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাৎক্ষণিক দেনমোহর কত হবে তা সাধারণত কোন এলাকার প্রথার উপর নির্ভর করে। তাউফিকুন্নিসা বনাম গোলাম কাম্বার এলাহা মামলায় এক-তৃতীয়াংশকে তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে যুক্তিসঙ্গত বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে।

তাৎক্ষনিক দেনমোহর প্রদান করার আগ পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে আপত্তি জানাতে পারেন এবং স্বামীকে বিরত রাখতে পারেন।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ১০ ধারা অনুসারে, দেনমোহর প্রদান সম্পর্কে কাবিনে উল্লেখ না থাকলে তা তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে এবং স্ত্রী চাওয়া মাত্র তা তাকে প্রদান করতে হবে।

কাবিন

আমাদের সমাজে কাবিন আর দেনমোহরকে একই অর্থে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়, লক্ষ করবেন অনেকে বলে ১০ লক্ষ টাকা কাবিন করেছি বা কাবিন করে রেখেছি বিয়ে পরে হবে ইত্যাদি।

আসলে কাবিন হচ্ছে বিয়ের চুক্তি বা তার লিখিত রূপ, ইসলামে এই লিখিত রূপের কথা বলা হয়নি কিন্তু আমাদের দেশে The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 দ্বারা কাবিন ও নিবন্ধন হয়ে থাকে তাই আলাদা করে কোন চুক্তি পত্র করার প্রয়োজন নেই। তাই কাবিন বলতেই আইনত বিয়ে বোঝাবে আর যদি তা না হয় তবে সেই কাবিন অবৈধ হবে। এখন এই চুক্তির একটি বিষয় হচ্ছে দেনমোহর তাই বলা যায় দুটি বিষয় এক নয় যদিও আমরা প্রচলিত ভাবে তা এক হিসেবে ধরে নেই।

 

উৎপত্তি ও বর্তমান

আরবে ইসলামিক যুগ সূচনা হওয়া আগে সেখানে বিয়ের জন্য অনেকটা কেনা-বেচা করার মত কন্যাকে অর্থের বিনিময়ে তার পিতার কাছ থেকে নিয়ে যেতো। ইসলাম চালু হওয়ার পরে এই প্রথার অবসান ঘটায় এবং এই অর্থ কন্যাকে তার অধিকার হিসেবে দেয়ার নিয়ম করে দেওয়া হয়।

বর্তমানে যেহেতু আমারা একটি পুরুষতান্ত্রিক দেশ তাই মেয়েদের এখনো অবহেলিত ভাবা হয় এবং ভাবা হয় যে একটি মেয়েকে সবসময় তার স্বামীর উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়, স্বামী যদি বিয়ে করেন বা ছেড়ে চলে যান তবে মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে তাই  দেনমোহরকে অনেকে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা হিসেবে দেখেন এবং অবস্থা বুঝে উচ্চ মূলে দেনমোহর নির্ণয় করেন। যাতে দেখা যায় অনেক সময় হিতে-বিপরীত হয়। এই বিষয়ে আমরা লেখার শেষ অংশে বাস্তবতার আলোকে আলোচনা করবো। এখন দেখে নেওয়া যাক তাহলে দেনমোহর ধার্য করার ব্যাপারে আসলে আইন কি বলে?

দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান

দেনমোহর কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?

দেনমোহর হিসেবে স্বামী স্ত্রীর প্রতি  যে কোন পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা যেতে পারে, যদিও তা তার ক্ষমতার বাইরে থাকে ।  তবে তা কোন অবস্থাতেই তা দশ দিরহামের কম হবে না ( হাদিস – বায়হাকি শরীফ, ৭/২৪০) অর্থাৎ সর্বনিম্ন দেনমোহর হতে হবে দশ দিরহাম বা এর সমপরিমাণ (বর্তমান) বাংলাদেশি টাকা। তবে, ১৮৭৬ সালে অযোধ্যা আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে এমন দেনমোহর নির্ধারণ করতে হবে যা স্বামীর দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং স্ত্রীর মর্যাদা অনুযায়ী যুক্তি সঙ্গত।

অন্যদিকে অন্য এক কেইস লতে আমরা পাই,  “ন্যায্য” দেনমোহর কত হবে তা স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন মেয়ের ফুফু, মা এদের ক্ষেত্রে কত ছিল তা বিবেচ্য হবে। [হেদায় ৪৫, বেঈলী,৯২] তবে যদি কোন কারণে বিয়ের সময় দেন মোহর ঠিক না হয়ে থাকে বা যথাযথ না হয়ে থাকে (কম হয়) তবে পরে আদালত তা যথাযথ ভেবে নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পরিশেষে বলা যায় যে ন্যায্য দেনমোহরের বিষয়টি তুলনামূলক ভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য।

দেনমোহর কখন পাবে বা পাবে না?

মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর নিকট একটি ঋণ স্বরূপ, তাই দেনমোহর পরিশোধ করতেই হবে যদিও এর দু একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। চলুন বিষয়গুলো একটু দেখে নেই।

সাধারণ ভাবে দেনমোহর পাবেন

সাধারণ ভাবে বিয়ে হলে এবং দাম্পত্য মিলন হলে স্ত্রী পূর্ণ দেনমোহর পাবেন। কিন্তু যদি শুধু বিয়ে হয় কিন্তু কোন দাম্পত্য মিলন না হয় তবে মোট দেনমোহরের অর্ধেক পরিমাণ দেনমোহর পাবেন। কিন্তু যদি বিয়ে হয় কিন্তু  দাম্পত্য মিলন হওয়ার পূর্বেই স্বামী মৃত্যুবরণ করেন সে ক্ষেত্রে পূর্ণ দেনমোহর প্রদান করতে হবে।

দেনমোহর পাবেন না

যদি এমন হয় দেনমোহর হিসেবে অর্থের বদলে অন্য কিছুকে মূল্যবান ধরে তা পাওয়ার চুক্তিতে বিয়ে করে তবে তাও দেনমোহর হবে, যেমন অর্থ বা সম্পদ প্রদানে অপারগ হয়ে হাদিসে কুরান শিক্ষাকে দেনমোহর হিসেবে ধরে বিবাহের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এমন ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে দেনমোহর নাও পেতে পারেন।

দেনমোহর মাফ করলে

স্ত্রী কোন কারণে বা কারণ ছাড়াই স্বামীর দেনমোহর আংশিক বা পূর্ণ ভাবে মৌকুফ করতে পারে। তবে সেটা স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতিতে হতে হবে। যদি এমন হয় কোন একটা বিশেষ অবস্থার কারণে বা চাপে পড়ে দেনমোহর মৌকুফ করা হয় তবে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের দেশে অনেক সময় ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে দেনমোহর মাফ করানো হয় যাতে আসলে সজ্ঞানে স্ত্রী মত দেয় না বরং কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়। যদি কেই সজ্ঞানে ও বুঝে-শুনে দেনমোহর মাফ করে তবে শুধু সে ক্ষেত্রে দেনমোহর মাফ হবে।

দেনমোহর সম্পর্কে আরো কিছু প্রশ্ন ও উত্তর;

উপহার দেনমোহর নয়

আমাদের দেশে আর একটি প্রাকটিস হলে যে স্ত্রীকে যে স্বর্ণ গয়না দেওয়া হয় তাকে টাকার মূল্যে ধরে নগদ উসুল হিসেবে দেখানো হয় এবং তা তাৎক্ষনিক দেনমোহরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রকৃত পক্ষে কোন উপহার তা হোক বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে তা দেনমোহরের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না তবে যদি উভয় পক্ষের সম্মতিতে সরাসরি প্রকাশ করে দুই পক্ষ একমত হয়ে কোন কিছুকে দেনমোহর হিসেবে ধরতে চায় তবে তাতে কোন বাধা নেই।

স্ত্রী তালাক দিলে কি দেনমোহর দিতে হবে?

হ্যাঁ দিতে-ই হবে যদি আপনি (স্বামী) কাবিননামার ১৮ ঘরে টিক দিয়ে স্ত্রীকে আপনার তালাক প্রদান করার ক্ষমতা তাকে হস্তান্তর করে থাকেন (তালাক-ই-তৌফিজ) বা সে আদালতের মাধ্যমে তালাক দেয় তবে খুলা বা মাবারতের মাধ্যমে তালাক দিলে আপনার হাতে কিছু ক্ষমতা থাকে যার মাধ্যমে আপনি হয়তো দেনমোহর না দিয়েও তালাক পেতে পারেন। তালাক সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন এখানে: মুসলিম স্ত্রীর দ্বারা তালাক ও আইন

স্ত্রী ব্যভিচার করলে কি দেনমোহর দিতে হবে?

হ্যাঁ, দিতে হবে। মাজার বিষয় হোল ব্যভিচার করলে স্ত্রীর কোন সাজা হয়না কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি জেনেশুনে অন্যের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় সেই ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করা হয়। এই ব্যভিচার আইন নিয়ে আলোচনা করার মত অনেক মজার বিষয় রয়েছে যা আপনার আগ্রহ প্রকাশ করলে লিখবো। আগ্রহী হলে নীচে কমেন্ট করুন।

দেনমোহর কিভাবে আদায় করতে হয় / দেনমোহরের মামলা

তাৎক্ষণিক দেনমোহর স্ত্রী যে কোন সময় চাইতে পারে এবং স্বামী তা দিতে বাধ্য থাকবে অন্যদিকে বিলম্বিত দেনমোহরের ক্ষেত্রে; তালাকের মাধ্যমে বা মৃত্যুর মাধ্যমে বা যখন স্ত্রী বা সালিশ পরিশোধের অনুমতি ছাড়া স্বামী আরও একটা বিয়ে করে বা যখন শর্ত সাপেক্ষে আগে থেকেই বিলম্বিত দেনমোহর দেয়ার ব্যপারে স্বামী স্ত্রী একমত হয় তেমন অবস্থার সৃষ্টি হলে যত দ্রুত সম্ভব দেনমোহর প্রদান করবে।

স্বামীর মৃত্যু হলে, কোন ব্যক্তির ঋণ যেমন আগে শোধ করতে হয় তেমনি দেনমোহরও আগে পরিশোধ করতে হবে উল্লেখ্য এতে করে স্ত্রী হিসাবে তিনি যে সম্পত্তি পেতেন তার উপর কোন প্রভাব পড়বে না।

এখন যদি এমন হয় যে দেনমোহর চাওয়ার পরও দেনমোহর স্বামী বা তার পক্ষ (তার মৃত্যু হলে) দেনমোহর প্রদান করছে না তবে স্ত্রী বা তার পক্ষকে দেওয়ানী আদালতের দ্বারস্থ হয়ে দেনমোহর আদায় করতে হবে।

তাৎক্ষনিক দেনমোহরের ক্ষেত্রে স্বামী দেনমোহর দিতে না চাইলে  স্ত্রী স্বামীকে  চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে তালাক দিতে পারবেন। (স্ফুরা খাতুন বনাম ওসমান গনি মোল্লা ১৯৫৭, ৯ ডি.এল.আর ৪৫৫) সাথে আদালতের মাধ্যমে দেনমোহর আদায় প্রক্রিয়াতো আছেই।

কত দিনের মধ্যে?

তামাদি আইন, ১৯০৮ এর তফসিল -১ এর  অনুচ্ছেদ ১০৩ ও ১০৪ অনুসারে;

কোন আদালতে?

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৫ অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে (Assistant Judge’s Court) সরাসরি মামলা করে দেনমোহর আদায় করা যায় (ধারা ২৫) এজন্য আপনাকে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায় অনেক নারী অনেক অসহায় হয়ে থাকেন তারা বিষয় গুলো বোঝেন না বা আর্থিক বা অন্য অসামর্থ্যের কারণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন না, সেক্ষেত্রে আপনারা সরকারি লিগ্যাল এইড বা বেসরকারি এনজিও গুলোর দ্বারস্থ হতে পারেন তারা এসব বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। তবে এসব ক্ষেত্রে অনেক বেনামি এনজিও মানুষের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন / খরচ ইত্যাদি বলে কিছু টাকা হাতিয়ে নিতে চায় এইসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

অতিরিক্ত দেনমোহর ও সামাজিক সমস্যা

আমরা আগেই দেনমোহরের উৎপত্তি ও বর্তমান সমাজে অধিক দেনমোহর ধার্য করার প্রবৃত্তির কথা বলেছি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিক দেনমোহর ধার্য করা কি আদও সমস্যার সমাধান নাকি নতুন সমস্যা তৈরি করা তা ভেবে দেখা প্রয়োজন, সাথে এটাও ভাবা প্রয়োজন যে আমরা আইন এবং ধর্মকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করছি নাকি নিজেদের লোভ লালসা এবং নিজেদের ইনসিকিউরিটির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছি? চলুন বিষয়গুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা যাক।

ইসলামের স্বর্ণযুগে দেনমোহরের প্রচলন শুরু হয় যেখানে ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় সমাজ চলতো এবং বোধ করি ব্যবস্থাটা সঠিক-ই ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে আমারা ঠিক সেই অবস্থানে নেই। আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে আমারা বেশির ভাগ সময় এক মিশ্র ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছি যেখানে আমরা অনেক নতুন ধারনা ও তত্ত্বর সাথে পরিচালিত হচ্ছি। যেখানে আমাদের দাবি দাওয়াগুলোও অনেক ভিন্ন। যেমন ধরুন, নারী শিক্ষা, স্বাধীনতা, বিয়ের ব্যাপারে নারী পুরুষের বিয়ের বয়স ও ইচ্ছের গুরুত্ব ইত্যাদি এখন অনেক আলাদা এর ফলে মানুষ অনেক সময় এই দেনমোহর  ব্যবস্থার ফায়দা ওঠাচ্ছে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

উপরের ঘটনাগুলো বাস্তবতা থেকে ধার করা। এখানে দেনমোহর ব্যবস্থার কোন সমস্যা নেই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেনমোহরের ব্যবহারে, কে কি ভাবছে এবং কে কিভাবে এটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এখন আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বা আইন ব্যবস্থা যদি পূর্ণ ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা হত তবে এর অনেক গুলো ঘটতোই না আবার অনেক গুলো ঘটলেও তার বিধি ব্যবস্থা নেওয়া যেত কিন্তু যেহেতু আমার এক মিশ্র ব্যবস্থায় চলছি তাই এগুলো সমাধান করাটা কিছুটা কঠিন এবং তত্ত্ব ও আইন অনেক যায়গায় কিছুটা সংঘর্সিক।

একটা মাজার বিষয় হচ্ছে ইসলামিক যুগে কত দেনমোহর তা আলোচনা সাপেক্ষে বরপক্ষ ঠিক করতো কিন্তু এখন এটা কনে পক্ষের একটা শর্ত হিসেবে থাকে যদিও বিয়ের পূর্ব শর্ত হিসেবে কোথাও দেনমোহরের কথা বলা নেই। তবে বলা আছে বিয়ে হয়ে দেনমোহর দিতেই হবে।

এখন যেখানে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, নিজে ইনকাম করতে শিখছে সেখানে উচ্চ মূল্যে দেনমোহর নির্ধারণ করে তাদের সিকিউরিটি মেনটেইন করার বিষয়টা হাস্যকর এবং স্বার্থপর এর ফলে নারীরা নিজেদের স্বাধীনতাকে সগৌরবে প্রকাশ করতে পারছেনা না ও নারী অধিকারের দাবির স্বকীয়তা হারাচ্ছেন। সাইকোলজিক্যাল ভিউ থেকে পুরুষরা তাদের কে নিজেদের অধীনস্থ ভাবছেন এবং অবমূল্যায়ন করছেন। যা কাম্য নয়।

কিন্তু তবুও স্ট্যাটাস, ক্লাস ও লোক দেখানোর কারণে কিম্বা সুধু কিছু মুরুব্বিদের খুশি করতে পাত্র-পাত্রী উচ্চ দেনমোহরে বিয়ে করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন। 

তাই বিয়ে করার আগে নিজের ও নিজের অবস্থানের কথা আগে ভাবুন। অন্যের কথা ধরে বা লোকে কি ভাববে ভেবে কিছু করতে যাবে না। মনে রাখবেন আইনি  দায় ও দায়িত্ব কিন্তু শুধু আপনার আর কারো নয়। আজ যে আপনার জন্য জীবন দিতে পারবে বলছে কাল সে আপনাকে মারার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে। সুধু আপনি নন সাথে সাফার করতে পারে দুটি পরিবার ও নিষ্পাপ সন্তান। তাই ভেবে কাজ করুন।

যেভাবে সমাধান করা যেতে পারে

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যেখানে পাত্রী স্বাবলম্বী বা স্বাবলম্বী নয় কিন্তু স্বামী স্বাবলম্বী হতে পূর্ণ সাহায্য করছে সেখানে দেনমোহর হওয়া উচিৎ ন্যূনতম ও ন্যায্য। অন্যদিকে যেখানে পাত্রী স্বাবলম্বী নয় এবং স্বামী চায়না সে স্বাবলম্বী হোক সেখানে আসলেই পাত্রীর ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটু বেশি দেনমোহর ধার্য করা উচিৎ যাতে করে ধার দেনা করে হলেও যেন পাত্র তা পরিশোধ করতে পারে এবং মেয়েটির জীবন একটু সুরক্ষিত থাকে। আর এমন ক্ষে্ত্রে স্বামী বেশ বড়লোক হয়ে থাকলৈ তার সম্পত্তির অর্ধেক পর্যন্ত পাওয়া তার অধিকার হতে পারে।

আবার অন্যদিকে স্বামী স্ত্রী দুজনেই একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলে সংসারে খরচ করতে পারে এবং এক সাথে সেভিংস করতে পারে। যাতে করে তাদের বিভাজন হলে সেই টাকা পয়সাও সমপর্যায়ে বিভাজন হয় এতে বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও ভরসা বাড়বে। 

আমাদের প্রিয় নবীর জীবনীতেও দেখবেন যে তিনি যখন খাদিজা (রা:) [খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ] কে বিয়ে করেন তখন খাদিজা (রা:) এই সমতা মেনে সংসারে ও ইসলামের জন্য তার সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু পুরুষ নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায় এবং কিছু নারী তাদের সম্পদ জমিয়ে রাখতে চায় যা ঠিক সমঅধিকারের বিপরীত। 

আইনে আরও যা থাকলে ভাল হয়

আইনের পবিবর্তন কি সম্ভব?

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সবাইতো এইসব নিয়ম মানতে চাইনে নাও পারে, তারা ট্র্যাডিশনাল আইনে বিশ্বাসী হতে পারে, সেক্ষেত্রে আমি বলব এগুলো অপশন হিসেবে বিয়ের সময় থাকতে পারে তারা কোনটা ফলো করবে সেটা তারা নির্ধারণ করবে এতে করে কোন দ্বন্দ্ব হবে না। আর সরকার চাইলেই এমন ব্যবস্থা করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, সরকার প্রায় সময়েই বর্তমান সমাজের অবস্থা চিন্তা করে ব্যক্তিগত / ধর্মিও আইনের উপর কিছু বিধি-নিষেধ, সংশোধন, প্রক্রিয়া সংযুক্ত করে, উদাহরণ স্বরূপ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তারা মূল ইসলামিক আইনের সাথে ন্যয়ের স্বার্থে কিছু বিধি নিষেধ যুক্ত করেছেন। তবে সরকার কখনোই একটা করবে না যদিনা আমরা আমাদের অবস্থান থেকে দাবি না তুলি। তাই পজিটিভ পরিবর্তনের জন্য নিজের মত প্রকাশ জরুরী।

অন্যদিকে বিয়ে যেহেতু একটি সিভিল কন্ট্রাক্ট তাই আমি মনে করি এই চুক্তিতে দুই পক্ষের কোন বিশেষ শর্ত থাকতেই পারে তবে এটা ফারদার জুডিশিয়াল এবং লিগ্যাল ডিসকাশনের বিষয়।

আশা করি দেনমোহরে কনসেপ্ট, প্রেক্ষাপট, বর্তমান সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা আপনাদের ভাল লেগেছে। যাওয়ার আগে এটা বলে রাখা ভাল যে এসব বিষয়ে একেক জনের একে ধরনের মতামত ও রেফারেন্স আছে। বিশেষ করে পিউর ধর্মের ব্যাখ্যা ও আইনের ব্যখ্যা অনেক সময়েই আমি ভিন্ন হতে দেখেছি কিন্তু সঠিক নির্ণয় করতে যত বড় স্কলার হওয়ার প্রয়োজন আমি তত বড় স্কলার নই তাই আইনে পাওয়া কিছু বিষয় আমার বোধ দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এছাড়াও দেনমোহর সম্পর্কিত বাস্তব জীবনের অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে তা লিখতে পারেন। উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। আর হ্যাঁ কোন ঝামেলায় পড়ে গেলে অবশ্যই দেরী না করে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করুন।

বন্ধুদের জানান
Exit mobile version