পালিয়ে বিয়ে / বিয়ে করার আইনি পদ্ধতি

বাঁধনহারা হয়ে ভালবাসার মানুষটিকে কে না কাছে পেতে চায়? সবাই চায় সে তার নিজের মানুষটিকে নিয়ে ভাল থাকবে, গড়বে সুখের সংসার কিন্তু বাস্তবতা হয়তো কখনো কখনো আইন এবং ভালবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় তাই অনেকেই চায় পালিয়ে বা লুকিয়ে বিয়ে করতে। কিন্তু তখনি মনে আসে হাজারো প্রশ্ন;

বিয়েটা কিভাবে করতে হবে? ছেলে মেয়ের কি কি সক্ষমতা লাগবে? বিয়েটা কোথায় করতে হবে? পরিবার যদি মেনে না নেয় তবে কি হবে? মেয়ে-পক্ষ কি মিথ্যে মামলা করতে পারবে? করলে কি হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
পালিয়ে বিয়ে

পালিয়ে বিয়ে করার আগে আইন জানুন

এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজবো তবে আগে আসি বাস্তবতায়। এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে তরুণ বয়সে অনেকেই হয়তো নিজের মধ্যেই নিজে শেষ হয় যায়, অনেকে আবার সাহস করে এগুলোও আইন কানুন এবং নিজের অধিকার না জানার কারণে নাজেহাল হয় বা মানুষের হাতের খেলার পুতুল হয় শুধুমাত্র অল্পকিছু মানুষ-ই সঠিক মানুষের দ্বারস্থ হয়ে সঠিক কাজটি করে উঠতে পারে তাই আমাদের উদ্দেশ্য যারা পালিয়ে বা লুকিয়ে বিয়ে করার কথা ভাবছেন তাদের ভাল ও মন্দ দিকগুলো জানিয়ে সঠিক পথে পরিচালনা করা।

আমাদের দেশের বহুল প্রচারিত একটি ধারনা যে পালিয়ে বা লুকিয়ে বিয়ে করতে হলে কোর্ট ম্যারেজ করতে হবে।

প্রশ্ন হল –

কোর্ট ম্যারেজ আসলে কি?

কোর্ট ম্যারেজ আসলে বিশেষ কোন ধরনের বিয়ে বা বিয়ের নিয়ম বা আনুষ্ঠানিকতা না বরং সাধারণ (পার্সোনাল – ধর্মিয়) বা বিশেষ আইন ছেলে ও মেয়ে বিয়ে করার পর তারা যে স্বেচ্ছায় ও নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছে সেই মর্মে একজন নোটারি পাবলিকের কাছে বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফ (এভিডেভিট) করে বলা এবং সেই মর্মে (২০০ টাকার নন জুডিশিয়ার ষ্ট্রাম্পে) একটি দালিলিক সাক্ষ্য তৈরি করা যাতে কোন পক্ষ এই বিয়ের বিষয়টি ইচ্ছে করলেই অস্বীকার করতে না পারে। এই বিয়ের কোন দলিল নয় শুধুমাত্র সমর্থনকারী (Supportive Document) দলিল।

কোর্ট ম্যারেজের ধারনার উৎপত্তি ও করণ হচ্ছে এই যে সাধারণত মুল ব্যক্তিগত আইনে (মুসলিম আইন – হিন্দু আইন) আগে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ছিল না বা এখনো হিন্দু আইনে বাধ্যতামূলক হয়নি এমন অবস্থায় অপহরণ বা ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে বা মেয়ে পক্ষ  এমন অভিযোগ করলে এবং সেই মেয়ে যদি সামাজিক কারণ বা অন্য কোন কারণে সত্য না বলে মিথ্যে বলে তবে সত্য প্রমাণ করা খুব কঠিন হয়ে যায় তাই এমন একটি এফিডেভিট বা হলফ ছেলে বা মেয়েকে এমন কোন ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে পারে। সাধারণত যেখানে বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের স্পষ্ট আইন রয়েছে বা রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছে যেমন,

মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন, ১ঌ৭৪ এবং এবং স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট, ১৮৭২ এর আওতায় রেজিস্ট্রেশন করা হলে আসলে এফিডেভিট করার প্রয়োজন নেই তবে র্বাতি সতর্কতার জন্য এবং যেখানে বিশেষ ঝামেলা হবে বলে মনে হয় এমন যায়গায় করে রাখাই ভাল এটি আপনার কেসটিকে আরও স্ট্রং হতে সাহায্য করবে।

অতএব এতক্ষণে এটা নিশ্চয়ই বোঝা গিয়েছে যে কোর্ট ম্যারেজ একটি পোশাকি নাম মাত্র যা মূলত একটি এফিডেভিট বা হলফ এবং এটা করার আগে আইন মেনে বিয়েটা করে নিতে হবে। চলুন দেখি বিয়েটা কিভাবে সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে হবে।

পালিয়ে করুন আর পারিবারিক ভাবে করুন বিয়ে করার পদ্ধতি আসলে একই তবে পালিয়ে বিয়ে করতে গেলে একজন অভিজ্ঞ মানুষ বা উকিলের পরামর্শে আগে থেকে কিছু বিষয় গুছিয়ে রাখা ভাল। চলুন দেখে নেই বিয়ে আসলে কিভাবে করতে হবে বা বিয়ে কিভাবে করলে আপনাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

বিয়ে যেভাবে করতে হবে?

মুসলিম বিয়ের জন্য

কোথায় করবেন বিয়ে?

আপনি বিয়ে করতে পারেন যেকোনো কাজী অফিসে। প্রথমেই একজন কাজীর কাছে যেতে হবে যিনি কিনা আইনগত ভাবে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যারেজ রেজিস্টার । সাধারণত যেকোনো ওয়ার্ড, পৌরসভায় কাজী অফিস থাকেই। আপনি এসব কাজী অফিসে আপনার বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র এবং সাক্ষী নিয়ে গেলেই কাজী আপনার বিয়ে পড়াবে। আর হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্ম মতে বিয়ে করতে পারবেন। এবং নোটারী পাবলিকের (সরকারী রেজিস্টার্ড উকিল) কাছে গিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে বিয়ের নিবন্ধন করতে পারবেন।

কাজীর কাছে নিন্মক্ত বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বলতে হবে এবং বুঝিয়ে দিতে তাকে বিয়ে দেওয়া তথা রেজিস্ট্রি করতে বলতে হবে।

বয়স: প্রথমেই আপনাকে দেখতে হবে যে বর ও কনের বিয়ের বয়স হয়েছে। বাংলাদেশের আইনে ছেলে মেয়ে উভয়ের বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট বয়স নির্ধারিত আছে। বিয়ের বয়স অবশ্যই মেয়ের বেলায় আঠারো ও ছেলের ক্ষেত্রে একুশ বৎসর হতে হবে এবং বয়সের প্রমাণ হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র যদি থাকে তা কাজীর কাছে নিয়ে যেতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র যদি না থাকে তবে এসএসসি পাশের সনদ কিংবা জন্ম নিবন্ধন পত্র সাথে নিয়ে গেলেই হবে।

বিয়ের বয়স সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আমাদের এই লেখাটি দেখুন: বিয়ের বয়স ও বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭

ছবি: ছেলে মেয়ের (বর ও কনের) দুইজনের দুই কপি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগবে।

সাক্ষী: বিয়ের জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক ২ জন পুরুষ অথবা ১ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সাক্ষী থাকতে হবে।

বিয়ের খরচা-পাতি;

কাবিন নামার খরচ যেকোনো বিয়ের ক্ষেত্রে একই। মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে একজন বিয়ে রেজিস্টার দেনমোহরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে একটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের ফি নির্ধারণ করে থাকেন। ধার্য্যকৃত দেনমোহরের প্রতি হাজার বা তার অংশ বিশেষের জন্য ১০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি। তবে রেজিস্ট্রেশন ফি এর পরিমাণ ১০০ টাকার কম হবে না এবং ৪০০০ টাকার উপরে হবে না। উল্লেখ্য রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধের দায়িত্ব বরপক্ষের।

আরও বিস্তারিত দেখুন এখানে: মুসলিম আইনে বিবাহ; পারিবারিক আইন

হিন্দু আইনে বিয়ে:

হিন্দু আইনে বিয়ে করতে হলে বর ও কনেকে যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ বছর বয়সের হতে হবে।
হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় অবশ্য পালনীয়:

  • যজ্ঞ কুশণ্ডিকা: পবিত্র যজ্ঞাগ্নির (আগুনের) সম্মুখে শাস্ত্রীয় মতে বেদমন্ত্র পাঠ করা।
  • সপ্তপদী: যজ্ঞাগ্নির (আগুনের) সম্মুখে বর-কনে যুগ্ম ভাবে সাত-পাক হাটা।

হিন্দু আইনে যেহেতু রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয় তাই নিবন্ধন না করলেও হয় কিন্তু সেক্ষেত্রে কোন যথাযথ দালিলিক প্রমাণ থাকে না তাই হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ এর অধীনে নিবন্ধন করে ফেলাই ভাল। অন্য দিকে একটি হলফনামাও করে রাখা যেতে পারে।

বিস্তারিত দেখুন এখানে: হিন্দু বিবাহ; পারিবারিক আইন 

ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে

যদি এমন হয় যে দু জন মানুষ (বর-কনে) দুইটি পৃথক ধর্ম পালন করে তবে তারাও বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এর মাধ্যমে বিয়ে করতে পারবেন, এই বিষয় বিস্তারিত দেখুন এখানে: ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে এবং বিশেষ বিবাহ আইন।

সতর্কতা

এই পর্যন্ত মেনে চললে কে আর ঠেকাবে আপনাদের বিয়ে, তবে হ্যাঁ পরবর্তীতেও কিছু আইন জটিলতা মানুষ তৈরি করতে পারে কিন্তু যদি স্বামী – স্ত্রী সঠিক ভাবে আইন মেনে বিয়ে করে তবে ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে হ্যাঁ সতর্ক থাকতে হবে। দুজনকে এক থাকতে হবে কোন ভাবেই ভেঙ্গে পড়া চলবে না। চোখ কান খোলা রাখতে হবে, কিছু অর্থ সংগ্রহে রাখতে হবে কিন্তু নির্ভরযোগ্য মানুষ ও আইন জানা ও বোঝা মানুষের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ কর্ম করতে হবে কারণ নির্দোষ হলেও আমাদের বিচার ব্যবস্থা বিচারের আগেই অনেক বাস্তবিক সাজা পেয়ে জান।

অনেক সময় দেখা যা বিয়ের পরে দুই পক্ষের বাবা- মেনে নেন না। অনেক সময় মেয়ের বাবা ক্ষেপে গিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন। মামলাগুলো হয় সাধারণত অপহরণ পূর্বক ধর্ষণের। এই মামলাগুলোর জামিন বা রিমান্ড শুনানি এবং বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। মামলার ধারাগুলো জামিন-অযোগ্য এবং আমলযোগ্য, পুলিশ এসব ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের অনুমতি ছাড়াই আসামিকে গ্রেফতার করতে পারে।

পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কিন্তু প্রথমেই জামিন হবে না। আর মানসিকভাবে শক্ত থাকুন, দুজনেই। মামলা (উক্তরূপ) হওয়ার পর তদন্ত শুরু হবে। ভিকটিমের (মেয়ের বাবার চোখে মেয়েটি এখানে ভিকটিম)জবানবন্দি দিতে হবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। এটি ২২ ধারার জবানবন্দি, ম্যাজিস্ট্রেট চেম্বারে হয় এবং এখানে কেউ কোনো প্রভাব খাটাতে পারে না।

জবানবন্দিতে মেয়েকে বলতে হবে, ‘আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। আমাকে কেউ অপহরণ করেনি।’ ব্যাস, তাহলে মামলায় পুলিশ আর চার্জশিট দেবে না। আসামি (ছেলে) অব্যাহতি পাবে।

সতর্ক থাকুন, নিজের অধিকার জানুন আর ভেবে চিন্তে কাজ করুন।

 

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

22 Responses

  1. mim says:

    form ta ki online e availble ache

  2. Abdur Rahman Akash says:

    ছেলে মেয়ের দুজনের বয়স যদি 18/19 থাকে তাহলে কী , কাজী রেজিস্ট্রেশন করবে….?

  3. ishtiak says:

    Meyer kache kono kabin nama nei..pawar bebosta ta akdom e nei..sei khetre meye kivabe kabin nama peye tar husband k divorce dite pare?

    • যে কাজীর কাছে বিয়ে হয়েছে তার তথ্য / এলাকা যোগাড় করে তার কাছ থেকে কাবিনের কপি উঠানো যাবে। আর ডির্ভোস দিতে কাবিনের প্রয়োজন নেই।

  4. নজরুল ইসলাম নয়ন says:

    আমার বয়স ২৪
    মেয়ের ১৭ কোন সমস্যা হবে নাকি?

  5. Ratan mondul says:

    ভাই পালিয়ে বিয়ে করতে হবে ।বয়স ঠিক আছে ।কাজীর কাছে গিয়ে বিয়ে করলে কি কোন সমস্যা হবে।মেয়ের বাবা কি কোন সমস্যা করতে পারবে।জানাবেন

    • এটা আপনার অবস্থার উপর নির্ভর করে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন বা কোন ভালো উকিলে স্বরনাপন্ন হোন।

  6. Sabit says:

    ভাই আমার বয়স ১৯ এবং মেয়ের বয়স ১৭,,এই অবস্থায় কিভাবে বিয়ে করা যাবে একটু জানাবেন প্লিজ

  7. সিজু says:

    ছেলের এবং মেয়ে ২ জনের আসল বয়স ২২+ কিন্তু ছেলের বয়স ভোটার আইডি তে ১৯+ এবং মেয়ের বয়স ভোটার আইডিতে ২১+ তাহলে কি বিয়ে করতে ঝামেলা হবে?

  8. masud raana says:

    সাক্ষীর নুন্যতম বয়স কত হতে হবে

  9. Toufica yesmin says:

    মেয়ের বয়স 18ছেলের বয়স18প্লাস ,,কিভাবে বিয়ে করা যায় একটু বলবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!