মুসলিম আইনে বিবাহ; পারিবারিক আইন – ২

আগের লেখায় হিন্দু বিয়ে সম্পর্কে লিখেছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিলো হিন্দু বিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। কিন্তু মুসলিম বিয়ে ঠিক তার উল্টো। মুসলমানের বিয়েতে ঝলমলে আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়লেও এটি বিয়ের কোন আবশ্যিক শর্ত নয়। দেওয়ানী চুক্তি করতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় মুসলিম বিয়েতেও সেই শর্তগুলো পালন করতে হয়। একারণে এই বিয়েকে পাত্র – পাত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক চুক্তি তথা দেওয়ানী চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তির বলে নারী – পুরুষ বৈধ (!) দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। একে অপরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

বিয়ের শর্ত

পারিবারিক আইন অনুসারে বিয়ের জন্য নিম্নে বর্ণিত শর্তগুলো পালন করা আবশ্যিক –

প্রস্তাব ও সম্মতি

বর – কনের স্বাধীন সম্মতি থাকতে হবে । অর্থাৎ সম্মতির কথাটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে হবে । কাজী ও সাক্ষীগণ নিজ কানে সম্মতির বিষয়টি শুনবেন। অনেক ক্ষেত্রে কাজীর সহযোগিতায় জোর করে কনের সম্মতি নেওয়া হয় বা না নিয়েই নেওয়া হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে নারীটি পরবর্তীতে বিয়ে অস্বীকার করত বিয়ে বাতিলের জন্য সহকারী জজ আদালতে ঘোষণামূলক মামলা করতে পারেন।

বয়স

১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ২১ হতে হবে । কাজী সাহেব বয়স পরীক্ষার জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বা এসএসসি সার্টিফিকেট বা ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেখে সন্তুষ্ট হবেন। কোন অবস্থাতেই নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কৃত বয়স প্রমাণের ঘোষণা গ্রহণযোগ্য হবেনা।

বিয়ের বয়স সম্পর্কে আরো জানতে দেখুন : বিয়ের বয়স ও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭


সাক্ষী

দুইজন সুস্থ মস্তিষ্কের প্রাপ্ত বয়স্ক সাক্ষী থাকতে হবে। একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে যে, একজন পুরুষ সাক্ষী সমান দুইজন নারী সাক্ষী। সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে চুক্তির ক্ষেত্রে দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য যথেষ্ট । এ আইন অনুসারে নারী – পুরুষের সমান মর্যাদা। সেখানে নারী – পুরুষের কথা পৃথকভাবে বলা হয়নি। এমনকি কাবিননামার ফর্মেও কোথাও একজন পুরুষ সাক্ষীর বিপরীতে দুইজন নারী সাক্ষীর কথা বলা হয়নি। এছাড়া ‘ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ ’ বা ‘ মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪ ’ বা অন্য কোন আইনে ‘ একজন পুরুষ সমান দুইজন নারী সাক্ষী ’ – এরুপ কোনো বিধান নেই।

উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে যেহেতু মেয়েটি ছেলেটির অর্ধেক পায় (২:১) সম্ভবতও সেখান থেকে এসেছে এই ধারণাটি। তো মূল বিষয় কমপক্ষে দুইজন সাক্ষী লাগবে। অবশ্য বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ অনুসারে ৩ জন সাক্ষী প্রয়োজন হয়।

দেনমোহর

প্রতিটি মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর থাকতে হবে। মোহরানা স্ত্রীর অধিকার। উদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের আর্থ – সামাজিক ব্যবস্থায় এই দেনমোহর সঙ্কটের কালে বেঁচে থাকার উৎস হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত। ঘর – গৃহস্থালির কাজ ছাড়া অন্যকোন কাজ তারা জানে না। এই নারী যখন বিধবা হয়ে যায় বা কোন কারণে বা কারণ ছাড়া তালাকপ্রাপ্ত হয় এবং ওই নারীর যদি দুই কূলে কেউ না থাকে বা থাকলেও তাকে ভরণ পোষণের সঙ্গতি না হয় তখন দেনমোহর হয় তার একমাত্র সম্বল।

বর্তমানে আর একটা ডিবেট প্রায়শ শুনি। যেহেতু নারী এখন আগের তুলনায় শিক্ষা দীক্ষায় অনেক অগ্রসরমান, ভালো উপার্জন করছে। স্বাবলম্বী হয়েছে। এখন কেন তাকে দেনমোহর দিতে হবে ? বা স্বামী যদি কপর্দকহীন হয় তাহলে ওই স্বাবলম্বী নারীটি কেন পুরুষটিকে দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেনা ইত্যাদি।

এই ধরণের অলস কূটতর্কে অংশ না নিয়ে বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে, দর্শনগত জায়গা থেকে দেখলে, হ্যাঁ দেনমোহর বিষয়টি পিতৃতান্ত্রিক ধারণা প্রসূত। কারণ, পুরুষ ধারনাই হচ্ছে নারী অবলা জাতি। পুরুষের উপর নির্ভরশীল। তাই পুরুষ অধিনস্ততার যূপকাষ্ঠে বলি নারীকে দেনমোহরের নামে তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কিছু আর্থিক সুবিধার বিধান প্রনয়ণ করেছে। কিন্তু তাই বলে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার সময় আসেনি যে, দেনমোহরের বিধান তুলে দেওয়াটাই হবে যুক্তিযুক্ত।

দেনমোহর দুই ধরণের । যথা ;

ক) তাৎক্ষনিক দেনমোহর ( Prompt Dower )
খ) বিলম্বিত দেনমোহর ( Deferred Dower )

দেনমোহরের একটা অংশ থাকে যা তাৎক্ষনিক, অর্থাৎ স্ত্রী দাবী করা মাত্র দিয়ে দিতে হয় । সাধারণত কাবিননামার নির্দিষ্ট কলামে তাৎক্ষনিক দেনমোহরের অংশ উল্লেখ থাকে। অংশ দেওয়া হয়ে গেলে উসুল বলা হয় । মনে করি মোট দেনমোহর চার লক্ষ টাকা । পঞ্চাশ হাজার টাকা তাৎক্ষনিক দেনমোহর হিসেবে ধার্য হলো । এই ধার্যকৃত টাকা দিয়ে দিলে লেখা থাকবে উসুল পঞ্চাশ হাজার টাকা। সাধারণত অলঙ্কার বা অন্যকোন মূল্যবান সামগ্রী প্রদান সাপেক্ষে উসুল দেওয়া হয়।

অপরদিকে বিলম্বিত দেনমোহর বলতে বুঝায় যা বিলম্বে প্রদান করা হবে ,অর্থাৎ স্ত্রীর চাওয়া মাত্র আদায়যোগ্য নয় ।
বিলম্বিত দেনমোহর আদায়যোগ্য হয় ৩ টি ঘটনা সাপেক্ষে –

১) স্বামী মৃত্যুবরণ করলে
২) বিবাহ বিচ্ছেদ হলে
৩) অনুমতি ছাড়া একাধিক বিয়ে করলে

দেনমোহরের ক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিস্কার যে, দেনমোহর মাফ হয় না। অনেক কেইস স্টাডিতে দেখা গেছে, বাসর রাতে স্বামী প্রবর বেশ আবেগে গদ গদ হয়ে ধর্মীয় দোহাই দিয়ে স্ত্রীকে দেনমোহর মাফ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে । সরলা স্ত্রী ইমোশনালী ব্ল্যাক মেইল্ড হয়ে অবগুণ্ঠনে মুখ লুকিয়ে মাফ করে দিয়েছে বটে। কিন্তু তাতে দেনমোহর মাফ হয় না । নারী অথবা পুরুষ তালাক যে – ই দিক না কেন স্ত্রীকে তার প্রাপ্য দেনমোহর বুঝিয়ে দিতে হবে। দেনমোহর আদায়ের জন্য মোহরানা দাবী এবং তা প্রত্যাখ্যান হবার ৩ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করতে হবে । অন্যথায় দাবী তামাদি হয়ে যাবে।

দেনমোহর কতো হবে এটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু ক্রাইটেরিয়া মেইন টেইন করা হয়। যেমন –

• কনের শিক্ষাগত যোগ্যতা , পারিবারিক স্ট্যাটাস
• কনের ফুফু, খালাদের দেনমোহরের পরিমাণ

যদিও এগুলো আইনত বাধ্যতামূলক নয়। তথাপি প্রচলিত সামাজিক নিয়ম হিসেবে এগুলো মেইন টেইন করা হয়।

স্বামীদের প্রতি আর একটা বিষয় উল্লেখ করে দেনমোহর আলোচনা শেষ করবো। কাবিননামায় উল্লেখকৃত দেনমোহরের টাকা স্বামী বিবাহ বলবৎ থাকা কালীন যে কোন সময় পরিশোধ করে দিতে পারেন। অনেক স্বামী, স্ত্রীর নামে জমি,বাড়ি ক্রয় করেন । খুবই ভালো কথা। অতঃপর স্বামী ভদ্রলোক ব্যাপক অহংকারে আহ্লাদে ডুবে যেতে যেতে রাতে স্ত্রীর কানে কানে বলে, ‘ এই বাড়িটি বা ওই জমিটি অথবা এই ২০ ভরি ওজনের হীরের নেকলেসটি তোমার দেনমোহর হিসেবে গিফট করলাম। আহা বেচারা! আসল কাজটি করতেই গেছে ভুলে! দলিলে লেখে নাই ‘ দেনমোহর হিসেবে ’ জমিটি দেওয়া হলো।

দেনমোহর সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জনাতে দেখুন: দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান

রেজিস্ট্রেশন

আইনের বিধানমতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার লিখিত ডকুমেন্টের নাম রেজিস্ট্রেশন। রেজিস্ট্রেশনের কাজটি যার দফতরে সাধিত হয় আইন অনুসারে তার নাম নিকাহ রেজিস্টার(Nikah Rejistrar), আমারা যাকে এতক্ষণ কাজী নামে ডেকেছি। রেজিস্ট্রেশন বিয়ের প্রামাণ্য দলিল । মুসলিম বিবাহ ও তালাক ( নিবন্ধীকরণ ) আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি বিয়ে অবশ্যই এই আইনের বিধান অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করতে হবে । যদি কোন মৌলানা বা হুজুর দ্বারা বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তবে বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বিয়েটি রেজিস্ট্রি করাতে হবে। বিয়ে রেজিস্ট্রি করার দায়িত্ব স্বামীর ।

উল্লেখ্য, স্বামী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শাস্তি স্বরূপ ২ বছরের বিনাশ্রম কারাবাস অথবা ৩ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ।

প্রত্যেকটি বিয়ের রেজিস্ট্রি ফী নির্ধারিত হয় দেনমোহরের টাকার উপর । প্রতি ১ লক্ষ টাকা দেনমোহরের জন্য ফী ১ হাজার টাকা। সর্বচ্চ ফী ৪ হাজার টাকা ( দেনমোহর ৭ লক্ষ টাকা হলেও ফী হবে ৪ হাজার টাকা ) এবং সর্বনিম্ন ফী ৫০ টাকা । এই ফী স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে । ফী’র পরিমাণ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক নিকাহ রেজিস্ট্রার ইচ্ছেমত ফী আদায় করে উপরি ইনকাম করে। সেই সাথে ‘ খুশী করে দেওয়া ’র ব্যাপারতো থাকেই।

কোর্ট ম্যারেজ ( Court Marriage )

এই বঙ্গীয় ব- দ্বীপে নানা রঙের আবেগ, সংস্কার, কুসংস্কার, প্রথা , ধারনার চাষাবাদ হয়। তেমনি একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে । মনে করা হয় কোর্টে গিয়ে বিয়ে করা মানেই কোর্ট ম্যারেজ । বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ বা নোটারী পাবলিক মহোদয়কে বিয়ে নিবন্ধনের কোন ক্ষমতা সরকার অর্পণ করেনি । এই ক্ষমতা একমাত্র নিকাহ রেজিস্টারের।

কোর্টে গিয়ে আসলে যেটা করা হয় তা হলো বিবাহ করতে ইচ্ছুক ছেলে – মেয়ে , ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিকের সামনে হলফনামা বা এফিডেভিট করে । এই ধরণের এফিডেভিট কোর্টে না গিয়ে সন্ধার পর নোটারী পাবলিকের চেম্বারে গিয়েও করা যেতে পারে । হলফনামায় পক্ষদ্বয়ের পরিচয়সহ সম্মতির বর্ণনা থাকে। মানে হলো তারা বিয়ে করতে ইচ্ছুক। হলফনামাটি সম্পাদিত হওয়া মাত্র একটি মূল্যবান দলিলে পরিণত হয় ।

মূলত অপহরণসহ বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমার হাত থেকে রেহাই পেতে এই হলফনামা সহায়ক হয় । অনেক ক্ষেত্রে ছেলে – মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক পারিবারিকভাবে স্বীকৃত হয় না। মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনো দেখা গেছে প্রেমিক যুগল ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ছেলের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে তাকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করে ছেলের বিরুদ্ধে অপহরণের মিথ্যে সাক্ষ্য দিইয়ে জেল খাটানো হয়েছে । বা পালিয়ে বিয়ে করে ফেললেও পরবর্তীতে মেয়েকে দিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার চেষ্টা করানো হয় যে, ছেলেটি সম্মতি ব্যতিরেকে জোর করে তাকে বিয়ে করেছে। এসব পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে সম্মতির ঘোষণা সম্বলিত এফিডেভিট অত্যন্ত কার্যকর।

কিন্তু মনে রাখতে হবে সম্মতির ঘোষণা সম্বলিত এফিডেভিট মানে কোর্ট ম্যারেজ নয় । এফিডেভিট করার পর কাজীর কাছে বিবাহ নিবন্ধন করা না হলে তা বৈধ বিয়ের শর্ত পূরণ করে না। বিয়ে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কাজীর কাছে নিবন্ধিত কাবিননামা বিয়ের মূল দলিল

 

বিয়ের প্রকারভেদ

গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে মুসলিম বিয়েকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয় । যথা

  • ১) বৈধ বিয়ে বা নিয়মিত বিয়ে
  • ২) অনিয়মিত বিয়ে
  • ৩) অবৈধ বা বাতিল বিয়ে

বৈধ বিয়ে বা নিয়মিত বিয়ে

যে বিয়েতে আইনে নির্ধারিত সবগুলো শর্ত পূরণ করা হয় তা-ই বৈধ বয়ে । বৈধ বিয়ের ফলাফল হিসেবে স্বামী – স্ত্রী’ র মধ্যে সহবাস ও সন্তান জন্মদান আইন স্বীকৃত হয় । একে অপরের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয় । স্ত্রী, সন্তানরা ভরণ পোষণ ও খোরপোষ পায় । স্ত্রী দেনমোহর পাওয়ার হকদার হয়।

অনিয়মিত বিয়ে

অনিয়মিত বিয়ে বলেতে যেখানে বৈধ বিয়ের কোন না কোন শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে । এই বিয়েকে ত্রুটিযুক্ত বিয়ে বলা হয় । অর্থাৎ আইনগত কোন বাধা এই বিয়েতে রয়ে গেছে। এই বাধা সাময়িক হতে পারে আবার স্থায়ী হতে পারে  মনে রাখতে হবে এটি অবৈধ বিয়ে নয়। নিচের অবস্থাগুলো বিবেচনায় একটি বিয়েকে অনিয়মিত বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হবে –

ক) আইন অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি স্ত্রী গ্রহণ করা

মুসলিম আইনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ও বিশেষ কিছু বিবেচনায় একজন পুরুষ সর্বচ্চ ৪ জন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে । এক্ষেত্রে ৫ম বিয়েটি অনিয়মিত বিয়ে হবে। এক্ষেত্রে পূর্বের ৪ জন স্ত্রীর মধ্য থেকে একজনকে তালাক দিলে বা তাদের মধ্য একজন মারা গেলে সর্বশেষ বিয়েটি নিয়মিত হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ৪ টি বিয়ের পর যতো সংখ্যক বিয়ে করা হোক না কেন তা বাতিল বা অবৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। সুতরাং ১৩/১৪ টি বিয়ে করা যেতেই পারে । আমরা পুরুষরা এই আনন্দে একটু নৃত্য করে নিতেই পারি :নৃত্য: :নৃত্য: :নৃত্য:। ও হ্যাঁ, একটু বাধা আছে , মানে শাস্তির ব্যবস্থা আছে  কঠোর শাস্তি কিন্তু !!! বিনা অনুমতিতে একের অধিক বিবাহ করলে ১ বছরের বিনাশ্রম কারাবাস অথবা (!) ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড ।

কঠিন শাস্তি বটে কি বলেন … ????

খ) সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতা

এমন দুইজন নারীকে বিয়ে করা যাবে না , যাদের মধ্যে একজন পুরুষ হলে বিয়েটি রক্ত সম্পর্কের কারণে অবৈধ হতো । যেমন – একই সাথে সহোদরা দুই বোন স্ত্রী হিসেবে থাকতে পারে না । এই দুই বোনের মধ্যে একজনকে কল্পনা করি ছেলে, তাহলে সম্পর্ক দাঁড়াচ্ছে ভাই – বোন । বলা বাহুল্য, ভাই – বোনের মধ্যে নিশ্চয়ই বিয়ে হতে পারে না । সুতরাং এরকম বিয়ে হয়ে থাকলে প্রথমটি ( আগে বিয়ে হওয়া বোন ) বৈধ বিয়ের মর্যাদা পাবে আর দ্বিতীয় বিয়েটি ( দ্বিতীয় বোন ) অনিয়মিত হবে । এক্ষেত্রে, প্রথম বোন মৃত্যু বরণ করলে বা তাকে তালাক দিলে দ্বিতীয় সহোদরার বিয়ের অনিমিত বাধা দূর হয়ে যাবে।

গ) ইদ্দত পালন কালীন বিয়ে করা

ইদ্দত বলতে বুঝায় বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পর যে নির্দিষ্ট সময় নারীকে পুনঃ বিবাহ থেকে বিরত থাকা । ইদ্দত কালীন সময়ে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলে বিয়েটি অনিয়মিত হবে। ইদ্দত কালীন সময় পার হওয়ার পর বিয়েটি নিয়মিত বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে।

ঘ) সাক্ষী ছাড়া বিয়ে করা

সাক্ষী ছাড়া বিয়ে হলে সেই বিয়েটি অনিয়মিত বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে। যে কোন সময় সাক্ষী দ্বারা সাক্ষ্য গ্রহণ পূর্বক বিয়েটি নিয়মিত তথা বৈধ বিয়েতে পরিণত করা যায়।

অবৈধ বা বাতিল বিয়ে

অবৈধ বা বাতিল বিয়ে আইনের দৃষ্টিতে কোন বিয়েই নয় । এটি Void – ab – intio অর্থাৎ শুরু থেকেই বাতিল ।

নিম্নে বর্ণিত ১৩ প্রকার নারীকে বিয়ে করা অবৈধ :

  • ১. আপন মা, বাবা ও দাদা-নানার স্ত্রীরা এবং তাদের কামভাব নিয়ে স্পর্শকৃত নারী। এরূপ ঊর্ধ্বতন সব দাদা-নানার স্ত্রীরা।
  • ২. মেয়ে এবং ছেলে ও মেয়ের ঘরের সব নাতনি।
  • ৩. সহোদরা, বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় ফুফু।
  • ৪. সহোদরা, বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় খালা।
  • ৫. সহোদরা, বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় বোন ও তাদের সন্তানাদি।
  • ৬. সহোদরা, বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃকন্যা ও তাদের সন্তানাদি।
  • ৭. দুধমাতা, তার মাতা, দাদি, নানি—এমনিভাবে ওপরের সব নারী।
  • ৮. স্ত্রীর মেয়ে, যদি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস হয়ে থাকে।
  • ৯. পুত্রবধূ, আপন ছেলের হোক বা দুধছেলের হোক।
  • ১০. আপন শাশুড়ি, দাদিশাশুড়ি, নানিশাশুড়ি এবং ওপরে যারা রয়েছে।
  • ১১. দুই বোন একত্রীকরণ, এমনিভাবে ফুফু ও তার ভাতৃকন্যা, খালা ও তার ভাগ্নিকন্যাকে একসঙ্গে বিয়ের মধ্যে রাখা।
  • ১২. উল্লিখিত রক্ত সম্পর্কের কারণে যারা হারাম হয়েছে, দুধ সম্পর্কের কারণেও তারা সবাই হারাম হয়।
  • ১৩. যে মেয়ে অপরের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব নারীকে বিয়ে করা হালাল। (দেখুন : সুরা : নিসা, আয়াত ২৩-২৪)
বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!