দেওয়ানী মোকদ্দমার ও ফৌজদারি মামলার পার্থক্য ও জরুরী কিছু বিষয়

আমরা কোন বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে সেই বিষয়টি অনেক ভাবেই আইন আদালতের কাছে পেশ করতে পারি। আমরা কিভাবে এবং কোথায় পেশ করলাম তার উপর নির্ভর করে যে আমাদের প্রতিকার বা ফলফল কি হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

ধরুন, রহিম আপনার প্রতিবেশী সে আপনার এবং আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম করে বেড়াচ্ছে যার ফলে আপনার তিলে তিলে গড়া সুনাম নষ্ট হয়েছে এবং আপনার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এমন অবস্থায় আপনার হাতে দুটি বিকল্প আছে।

  • ১। ফৌজদারী মামলা করা, যা করলে বিষয়টি প্রমাণ হলে সে বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে এবং সাথে অর্থ দন্ডও হতে পারে তবে তা সাধারণত খুবই নগণ্য হয়।

    প্রসঙ্গত, ফৌজদারী বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বলে ফৌজদারী মামলা বা Criminal Case অন্যদিকে দেওয়ানী বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বলে দেওয়ানী মোকদ্দমা বা Civil Suit

  • ২। দেওয়ানী মোকদ্দমা করা, যা করলে আদালত বিবেচনা করবেন যে আপনার কত টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং পরে আরও হতে পারে, এবং তার কি লাভ হয়েছে এবং অন্যান্য; এসব বিবেচনা করে আদালত একটা মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে বলবে, ধরুন সেটা হলে পার দেড় বা দুই কোটি টাকা।

সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে ফৌজদারী মামলা করলে যদি রহিমেরে দশ বছরের জেল ও হয় তবে তাতে মনোতৃপ্তি ছাড়া আপনার কিছু যাবে বা আসবে না। অন্যদিকে আদালত তাকে দেড় বা দুই কোটি টাকার জরিমানা করলে আপনা ক্ষতি পুষিয়ে আবার আপনি ব্যবসায় নামতে পারবেন।

প্রশ্ন হল আপনি হলে কোনটা চাইতেন, উত্তর দিতে পারেন আমাদের কমেন্ট সেকশনে

দেওয়ানি মোকদ্দমা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারনা পেতে দেখুন; দেওয়ানী মোকদ্দমা কি, কেন ও এর ধাপ সমূহ

যাইহোক এখানথেকে আমরা পেলাম আমাদের প্রথম পার্থক্য; –

১. ফৌজদারী মোকদ্দমায় জেল জরিমানা বা দেওয়ানী মামলায় প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ

পরের পার্থক্যটি হচ্ছে;

২. দেওয়ানি মোকদ্দমায় নিজে এবং নিজে খরচে মামলা পরিচালনা করতে হয় অন্যদিকে ফৌজদারী মামলাটি করে সরকার ও সরকারি খরচে

  • দেওয়ানি মামলায় যার যার সম্পত্তি বা অধিকার রক্ষার্থে তার তার নিজের খরচে উকিল নিয়োগ করে তার মাধ্যমে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে, অপর পক্ষকে আদালতের মাধ্যমে খরচ ইত্যাদি পরিশোধ করে নোটিশ পাঠিয়ে মোকদ্দমা পরিচালনা করতে হয়।
  • অন্যদিকে, ফৌজদারী মামলা সাধারণত সরকার করে থাকে। পুলিশের কাছে অভিযোগ যাওয়ার পর পুলিশ তা আদালতকে জানায়, আইনের এবং আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে পুলিশ তদন্ত ও গ্রেফতার করে এবং তারপর আদলেতে সরকার নিয়োজিত উকিল (পাবলিক প্রতিকিউটর) সেই মামলা বিনামূল্যে পরিচালনা করে।

জেনে রাখা ভালো: রাষ্ট্রের সকল সম্পদই কিন্তু আসলে সরকারের, তবে ধরে নেওয়া হয় যে সম্পত্তি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব জনগণের তাই দেওয়ানী মোকদ্দমায় মামলাগুলো হয় এমন যে রহিম বনাম করিম। অন্যদিকে, ফৌজদারী মামলা দেখলে দেখবে মামলার পক্ষগুলো সাধারণত এমন, রহিম বনাম রাষ্ট্র এখানে কোন Offence বা Penal law ভঙ্গ করলেই রাষ্ট্র ধরে নেয় সেটা তার বিরুদ্ধে অপরাধ তাই সে নিজেই বিচারের সব ব্যবস্থা করে।

দেওয়ানী - ফৌজদারি পার্থক্য

দেওয়ানী মোকদ্দমার ও ফৌজদারি মামলার পার্থক্য ও জরুরী কিছু বিষয়

৩. ফৌজদারী মামলায় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হয় কিন্তু দেওয়ানী মোকদ্দমার  ক্ষেত্র ভারসাম্যতার নীতি অবলম্বন করা হয়।

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত (Beyond reasonable doubt)

ক্রিমিনাল আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে, অভিযোগ প্রমাণ হওয়া আগে কাউকে দোষী বলা যাবে না এবং শাস্তি দেওয়া যাবে না কারণ তা না হলে বিচার প্রক্রিয়া আগেই পক্ষপাতমূলক হয়ে যেতে পারে আর এই নীতির সমর্থক নিতি হচ্ছে “সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত (Beyond reasonable doubt) নীতি” অর্থাৎ কেউ যে কোন অপরাধ করছে তা সন্দেহ ছাড়াই প্রমাণিত হতে হবে। একটি উদাহরণ দেই তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, “রহিমকে কেউ পিছন দিয়ে আঘাত করে পালালো এখন রহিমের ধারনা শত্রুতাবসত করিম এই কাজটি করেছে এবং আঘাত কারীর হাটা দেখে রহিমের তাই মনে হয়েছে, অন্যদিকে করিমকে ঘটনার ৫ মিনিট পরে ৫ কিলোমিটার দুরের একটি বাজারে চা খেয়ে গল্প করতে দেখা গেছে ” এই ঘটনা দেখলে আমাদের মনে সন্দেহ জাগে যে আসলেই কি কাজটি করিম করেছে? আমাদের মনে হয় হয়তো করতে পারে ৬০%-৪০% চান্স আছে। এমনটি হলে সেটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত নয়। এবং যেহেতু এখানে একজন মানুষকে জেলে দেয়ার ব্যাপার আছে কোন ভুল হলে তার সারা জীবন নষ্ট হবে তাই এখানে সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণ হতে হবে মানে ১০০ তে ১০০ ভাগ প্রমাণিত হতে হবে। এসব মামলায় সাধারণত চাক্ষুষ প্রমাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ভারসাম্যতার নীতি (Balance of probability) অবলম্বন

দেওয়ানী মামলায় ভারসম্যনীতি (Balance of probability)অনুসরণ করা হয়, সহজ কথায় হল ১০০ তে ১০০ প্রমাণ না করলেও হয়, তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যদি ৬০-৪০ অনুপাতে মামলাটি প্রমাণিত হয় তবে সেভাবেই আদালত রায় দেবেন।

বিষয়টা এভাবে সহজে বোঝা যায়, রহিম করিমকে ১ লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি করবে বলে চুক্তি করলো কিন্তু সঠিক ভাবে তা সম্পাদন (পালন) করলো না তাই করিম মামলা করল এবং ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ চাইল , এখন করিম প্রমাণ করতে পারলে যে চুক্তিটি সঠিক ভাবে সম্পাদন করা হয়নি অন্যদিকে রহিম প্রমাণ করলে হ্যাঁ সঠিক ভাবে সম্পাদিত হয়নি কিন্তু সে ৪০ হাজার টাকার ফুল করিমকে দিয়েছে। এখন আদালত দুই বিষয়ে দলিল পর্যবেক্ষণ করে লাভ ক্ষতি বিবেচনা করে রহিমকে বাকি টাকাটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে বলতে পারে।

উল্লেখ্য যে, দেওয়ানী মোকদ্দমায় দালিলিক সাক্ষ্যের উপর বেশী নির্ভর করে।

৪. প্রমানের দায়ভার

ফৌজদারী মামলায় [অভিযোগ] প্রমাণের দায়ভার মূলত ন্যস্ত থাকে রাষ্ট্রপক্ষর (বাদী) উপর অন্যদিকে দেওয়ানী মামলায় দুই পক্ষই তাদের দাবীকৃত বিষয় প্রমাণ করতে হয়।

৫. সময় ও ফল

দেওয়ানী মোকদ্দমায় দালিলিক সাক্ষ্যের উপর বেশী নির্ভর করার কারণে এবং এর ধরনের কারণে দেওয়ানী মোকদ্দমায় সাধারণত বেশী সময় লাগে এবং বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, অন্যদিকে ফৌজদারি মামলা সাধারণত আইনে বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শেষ করারা বাধ্যবাধকতা থাকে তাই সাধারণত কম সময় লাগে কিন্তু এই মামলায় চাক্ষুষ ও সরাসরি প্রমাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণ করতে বেশ বেগ পেতে হয় এবং সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করতে না পারলে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না।

ফৌজদারি মামলায় সাধারণত আইনে বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শেষ করারা বাধ্যবাধকতা থাকে তাই সাধারণত কম সময় লাগে কিন্তু এই মামলায় চাক্ষুষ ও সরাসরি প্রমাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণ করতে বেশ বেগ পেতে হয় এবং সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করতে না পারলে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না।

৬. পক্ষ-গন ও বিপক্ষের মৃত্যুর পরের ফল

দেওয়ানী মোকদ্দমায় বিপক্ষ ছাড়াও প্রয়োজনীয় অন্যান্য পক্ষকে মামলায় রাখতে হয় যাতে পরে কোন ঝামেলা না হয় এবং কোন পক্ষ মারা গেলে তার উত্তরাধিকাররা মামলার পক্ষ ভুক্ত হয়, মোকদ্দমাটি বিলুপ্ত বা শেষ হয়ে যায় না। এবং মৃত ব্যক্তির (বা তার উত্তরাধিকারদের) বিরুদ্ধে রায় গেলে সেই ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে সম্পত্তি উসুল করে দেওয় হয়।

অন্যদিকে, ফৌজদারী মামলায় সুধু অভিযুক্ত এবং তার সহযোগীকে মামলার বিবাদী করা হয় এবং তাদের মৃত্যুর পর অভিযোগটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

৭. রায় পাবার পরের প্রক্রিয়া ও জেল জরিমানা।

দেওয়ানী মোকদ্দমায় রায় পাবার পর বিবাদীকে সেই রায় মানার জন্য আহ্বান করা হয় যদি সে সেই রায় না মানে / রায় মতে কাজ না করে তবে দেওয়ানী আদালতে সেই রায় সম্পাদনের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। বিবাদী যদি ইচ্ছে করে রায় না মানে বা আইন বহির্ভূত কিছু করে বা করার চেষ্টা করে তখন আদালত চাইলে তাকে দেওয়ানী কারাগারে আটক রাখতে পারে, তার সম্পত্তি জব্দ ও বিচার করতে পারে এবং পুলিশ এবং প্রশাসনের মাধ্যমে রায় বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে পারে।

অন্যদিকে, ফৌজদারী মামলা এসব কিছুই করতে হয় না সরকার রায় ঘোষণার পরে রায় বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করে।

ভিডিও

আসুন ছক আকারে একনজরে বিষয়গুলো আবার দেখে নেই;

বিষয়ফৌজদারী মামলায় দেওয়ানী মোকদ্দমায়
প্রতিকার বা ফলজেল জরিমানাপ্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ
মামলা পরিচালনা ও খরচসরকার ও সরকারি খরচে পরিচালিত হয়নিজে এবং নিজে খরচে মামলা পরিচালনা করতে হয়
প্রমাণের নীতিঅভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হয়ভারসাম্যতার নীতি অবলম্বন করা হয়।
প্রমাণের দায়ভাররাষ্টপক্ষকে তাথা বাদীকে প্রমাণ করতে হয়দুপক্ষই তাদের বিষয় প্রমাণ করার চেষ্টা করে
সময়তুলনামূলক ভাবে কম সময় লাগেতুলনামূলক ভাবে বেশী সময় লাগে
ফলপ্রতিকার পাওয়া সহজ ও সাধাণত পাওয়া যায়প্রমান করা একটু জটিল বলে অনেক সময় আশাতীত ফল পাওয়া যায় না
রায়ের পরসরকার নিজে উদ্দ্যোগে সব ব্যবস্থা করেজারির মামলা করতে হয়

আশাকরি এই পাথ্যর্কগুলো বুঝলে আপনাদের আইন বুঝতে অনেক সুবিধা হবে এবং কোন আইনের মাধ্যমে কিভাবে মামলা করবে তা আপনাদের জন্য নির্ধারন করা সহজ হবে।

অনলাইনে বার কাউন্সিল পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আমাদের আইন পাঠশালা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করুন। সহজ হ্যান্ড নোট, কোর্স (বার কাউন্সিল পরিক্ষার প্রস্তুতি কোচিং ও অন্যন্য) পেতে আমাদের আইন পাঠশালা ওয়েব সাইটটি ভিজিট করুন।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!