Site icon আইন সেবা [ল হেল্প বিডি]

সংক্রামক রোগ বিষয়ক আইন ও সরকারের আটক ও জরিমানার ক্ষমতা (আপডেট)

করোনা ভাইরাস তথা COVID-19 বর্তমানে একটি পেনডেমিক হিসেবে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করেও সংক্রামণ ও মৃত্যুর হারে লাগাম দিতে পারছে না।  এমতাবস্থায় অনেক দেশ-ই শক্ত হতে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যার ফলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা না জাতীয় স্বার্থ এই বিষয়ে প্রশ্ন চলে আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কিছু প্রবাসী দেশে এসে কোয়ারাইন্টাইনে “Quarantine” বা পৃথক ভাবে থাকতে চাচ্ছেন না, কেউবা বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকতে হবে তাই ভেবে রোগটি গোপন করছেন আবার কেউ কোয়ারাইন্টাইনে থাকতে হবে শুনে হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছেন।

রাষ্ট্রের প্রতিটি আদেশ, বিধি-নিষেধ পরিচালিত হয় আইনের মাধ্যমে তাই বর্তমান উদ্ভূত করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন করা বা কোয়ারেন্টাইন থাকার আদেশ দেওয়া, সেই আদেশ ভঙ্গ করলে সাজা দেওয়া, রোগে ভুগলে বাধ্যতামূলক ভাবে আইসোলেটেড করা, তথ্য দিতে বাধ্য করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করা, মৃত্যুবরণ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদিও আইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হতে হবে।

আমারা আইনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বাংলাদেশ আইনগত ভাবে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এবং ভবিষ্যতে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তা আপনাদের জানাবো যাতে করে আপনারা আইন মানেন এবং প্রয়োজনে অন্যকে আইন মানতে বাধ্য করতে পারেন।

আইনের ব্যাপারে বলতে প্রথমেই চলে আসে গত যে গত ১২-ই মার্চ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনস্বার্থে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি গণ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে যেখানে তারা উল্লেখ করেছে যে তারা ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ এর প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। আমরা এই আইন নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করবো, তার আগে বলে রাখি কিছু আইনি জটিলতায় তারা তাদের এই আইন প্রয়োগ থেকে সাময়িক ভাবে সরে এসেছে। বিস্তারিত পাচ্ছেন নিচের আপডেটে।

বর্তমানে যে আইন চলছে – আপডেট (20.03.2020)

প্রাথমিক ভাবে সরকার তথা প্রশাসন “ সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮”  ব্যবহার করতে চাইলেও এ বিষয়ে কিছু আইনগত প্রশ্ন দেখা দেয়। সংক্রামক রোগ হতে হলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ৪ ধারা মোতাবে প্রদত্ত ২৩ টি রোগের মধ্যে একটি হতে হবে যেখানে কভিড-১৯ নেই।

অন্যদিকে ধারা ৪ এর উপধারা (ভ) অনুসারে সরকারকে নতুন কোন রোগকে সংক্রামক রোগের স্বীকৃতি দিতে হবে অথবা এই প্রয়োগ করা যাবে না। তবে উল্লেখ্য যে ৪ ধারার এই লিস্টে (ঝ) মারস-কভ (MERS-CoV) এর উল্লেখ আছে যা এক ধরনের করোনা ভাইরাস-ই বটে। তবুও ব্যাখ্যা কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কভিড-১৯ কে বিশেষ ভাবে সংক্রামক রোগ হিসাবে স্বীকৃতি না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এই আইনের অধীনে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না।

এর কারন হচ্ছে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ বলা আছে retrospective law বা ভূতাপেক্ষভাবে কোনো আইন কার্যকর করে কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না, অর্থাৎ কোন আইন পরে হওয়ার পর সেই আইন দিয়ে আইন হওয়ার আগে যে অপরাধ সংগঠিত হয় তার বিচার করা বা সাজা দেওয়া যাবে না।

এমতাবস্থায় বর্তমানে প্রশাসন দন্ডবিধির বা পেনাল কোডের (Penal Code, 1860) চোদ্দ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। এই অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্য, জন নিরাপত্তা, স্বীকৃতি এবং নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চলুন এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা দেখে আসি।

তবে এটা আশা করা হচ্ছে যে সরকার খুব দ্রুতই কভিড-১৯ কে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ ধারা ৪ এর উপধারা (ভ) মোতাবেক সংক্রামক রোগ হিসাবে স্বীকৃতি দিবেন।

সংক্রামক রোগ বিষয়ক আইন ও সরকারের ক্ষমতা

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮

জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে সরকার ১৮৯৭ সালের The Epidemic Diseases Act, 1897 রহিত করে ২০১৮ সালে প্রণয়ন করে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮। 

এই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী ২৩ প্রকার রোগকে সংক্রামক রোগ হিসেবে উল্লেখ করে আরো বলা আছে, সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত (Emerging or Reemerging) রোগসমূহ সংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস (COVID-19) কে সংক্রামক হিসেবে চিহ্নিত করেনি, তবে অনতিবিলম্বে তা করা প্রয়োজন। কারণ আইনটির ৯ ধারা অনুযায়ী, ‘সংক্রামক রোগের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তার হইতে জনগণকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে উক্ত রোগসমূহ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, উক্ত রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সতর্কতা জারি ও পারস্পরিক সহায়তার সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এতদ্সংক্রান্ত শিক্ষা বিস্তার, রোগের উন্নতি পর্যালোচনা, অধিকার সংরক্ষণ সহ অন্যান্য পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) কর্তৃক, প্রকাশিত এবং তপসিলে উল্লিখিত International Health Regulations, প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহ, সামঞ্জস্য পূর্ণভাবে প্রয়োগ যোগ্য হইবে।’ যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) ইতিমধ্যে ভাইরাসটিকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটি এখন আর নির্দিষ্ট কোন অঞ্চল বা দেশে সীমাবদ্ধ নেই। 

এখন পর্যন্ত ১১৪টি দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, এবং ৪ হাজার ২৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ভাইরাসের কারণে। তাই বাংলাদেশের ও উচিত দেরি হয়ে যাবার আগেই যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই ৫ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পাশাপাশি এর সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। যেহেতু সংক্রমণ এর মাধ্যমে রোগ ছড়ানো একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় তাই এই আইনকে প্রাধান্য দিয়ে বলা হয়েছে, বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে। 

সংক্রমণ ঠেকাতে মহাপরিচালক যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন

আইনটির ১০ ধারায় বলা আছে, সংক্রমণের তথ্য  জানাতে হবে সিভিল সার্জন কে, তিনি মহাপরিচালক কে জানাবেন। এবং ১১, ১২ ও ২২ ধারা অনুযায়ী, রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে মহাপরিচালক কোন এলাকাকে – 

রোগ গোপন করার শাস্তি

একই আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি / সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসার  সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তার নিকট গোপন করেন তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা দিলে

২৫ ধারা অনুযায়ী,  যদি কোনো ব্যক্তি মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতা প্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, বা কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করলে

২৬ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

কারো মৃত্যু হলে

এই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে:

কোন সংক্রামক ব্যাধি হলে এই ধারার অধীনে প্রশাসন তার সৎকারের দায়িত্ব নিতে পারে এবং করোনা ভাইরাস বা আরও মারাত্মক কোন সংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যু হলে প্রশাসন আইনের এই ধারা বলেই সেই ব্যক্তির সৎকার কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে, এমন কি কাছের আত্মীয় স্বজনকেও কাছে আসতে বা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করতে নাও দিতে পারে।

এছাড়াও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক নাগরিক এটিকে একটি জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪১ক অনুচ্ছেদের প্রয়োগ করে সকল শক্তি দিয়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আহ্বান জানিয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও বহিঃশত্রুর কারণে কোন মারাত্মক অবস্থা হুমকি অনুধাবন করেন তবে তিনি এই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের যে কোন বিষয় তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে পারেন, দেশের সকল শক্তি তিনি প্রয়োগ করে কোন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারেন। তবে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলে সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার গুলো খর্ব হবে যেমন চলাচলে অধিকার, সমাবেশের অধিকার ইত্যাদি। তাই বর্তমানে সংবিধানের ১৪১ক অনুচ্ছেদের প্রয়োগ হবে না বলেই আশা করা যায়।

মনে রাখতে হবে, এইসব আইন কানুন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার কথা ভাবে করা এবং এগুলো মেনে চললে আমারা মহা বিপদে পরলেও হয়তো ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে তাই স্বেচ্ছাচারী না হয়ে আইন ও প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। কেউ আইন না মানলে প্রশাসনকে বা ৯৯৯ এক কল করে জানাতে হবে। আইন না জেনে বা না মেনে বিভ্রান্তি ছড়ানো যাবে না। এমতাবস্থায় আমাদের সকলের উচিত সচেতন থাকা, মিথ্যা তথ্য ও গুজব না ছড়ানো এবং করোনাভাইরাসের যে কোন লক্ষণ দেখামাত্র সরকারি হট-লাইন নম্বরে যোগাযোগ করা।

 

মূল লেখাটি প্রয়োজনীয় আপডেট, সংযুক্ত ও সম্পাদন করেছেন রায়হানুল ইসলাম
বন্ধুদের জানান
Exit mobile version