প্রাকৃতিক আইন মতবাদ (Natural Law Theory)
সব সমাজেই এমন কিছু কাজ আছে যা করলে লোকে নিন্দা করবেই। গর্ভপাতের আইনী বৈধতা থাকলেও অনেক দেশেই কাজটিকে অনৈতিক মনে করা হয়. এমন অন্যায় কেউ করলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে বলবে – ‘এটা তো একদম ঠিক নয়। ‘ ( it’s just not right)।
শুধু ঠিক-বেঠিক বলে নয় সামাজিক আচার বা সমাজ সঙ্গত বলেও একটা ব্যাপার আছে। দীর্ঘকালের রীতিনীতির ব্যত্যয় হলে সেটাকে মানুষ নির্দ্বিধায় – ‘অস্বাভাবিক’ (it’s not natural) এমনকি ‘ কদর্য‘ (it’s unfair) বলে, তাই না?
যেমন আমাদের সমাজে সমকামিতা অগ্রহণযোগ্য ৷ পাশ্চাত্যে সমকামিদের বিবাহ বিতর্কিত হলেও কিছু দেশে এটি আইনসঙ্গত। এই জাতীয় বিবাহকে অধিকাংশ বঙ্গবাসীই – প্রকৃতিবিরুদ্ধ অস্বাভাবিক কদাচার বলবেন- সেটা তো জানা কথা৷
কিন্তু প্রশ্ন হল, সমাজের এই যে সামষ্টিক নিন্দা এর উৎস কোথায়?
এমন কোন নিরপেক্ষ মানদণ্ড কি আছে যার দ্বারা বলা যায় কোন কাজটা সঠিক হচ্ছে আর কোনটা বেঠিক? স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকতাই বা বুঝবো কোন মাপকাঠিতে?
আরো গুরুত্ত্বপূর্ণ হল যদি এমন একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকা সত্যিই সম্ভব হয় তাহলে সেই পদ্ধতিটিই বা দাঁড়া করানো যাবে কি উপায়ে?
নৈতিকতার এমন অজস্র প্রশ্ন আমাদের জীবনজুড়েই রয়েছে ৷ রাজনৈতিক বিতর্কে বা আলোচ্য ক্ষেত্রের ন্যায় বিভিন্ন আইনী তর্ক-বিতর্কে এইসব প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসে, ‘ কী করা যৌক্তিক বা কোনটি ন্যায়সঙ্গত? আন্তর্জাতিক চুক্তি, রীতিনিতি বিশেষ করে মানবাধিকার সম্পর্কিত ঘোষণাপত্রে নৈতিকতার মর্মবাণীর ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে ৷ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তা আরও বেগবান হয়েছে ৷ এই চুক্তি রীতিনীতি, ঘোষণা থেকে ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে ‘নৈতিক সত্যের ‘ (Moral Truth) ধারণাটি আর বিচ্ছিন্ন বিমূর্ত (abstract) কোন বিষয় নয়। উপরে উল্লেখিত আইনগুলোতে নৈতিকতা প্রচ্ছন্ন হলেও যেকোন যুক্তিবাদী মানুষ চাইলেই ‘প্রাকৃতিক আইনের‘ (Natural Law) অন্তর্নিহিত নৈতিক সত্যের সন্ধান পেতে পারেন।
যদিও এরিস্টটল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দার্শনিকগন নীতিশাস্ত্রের অনেক সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি কিন্তু ‘প্রাকৃতিক আইন মতবাদ’ (Natural Law Theory) আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছে হাজার বছরের প্রাচীন সেই প্রচেষ্টায় এই যুগেও মানুষ কতটা পিছিয়ে আছে৷
প্রখ্যাত আইনজীবি জন ফিনিস ( John Finnis) এর মতে প্রাকৃতিক আইনের সর্বোত্তম সংজ্ঞা হলো, ‘প্রাকৃতিক আইন, আইন ও নৈতিকতার প্রতিচ্ছেদস্থল (intersection) অর্থাৎ আইন ও নৈতিকতা যেখানে একে অপরকে ছেদ করে সেখানেই প্রাকৃতিক আইনের স্থান। এই ব্যাখ্যার সারকথা বা মূলদাবি সোজা ভাষায়, ‘তাই হওয়া উচিৎ (ought to be) যা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিকভাবে (Naturally) হয়ে থাকে।
জন ফিনিস তার প্রখ্যাত – ‘প্রাকৃতিক আইন ও প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব (Natural Law And Natural Theory) গ্রন্থে দাবি করেছেন আইন ব্যাখ্যা করতে উদ্যত হলে সেটা ভালো নাকি মন্দ এই নৈতিক বিষয়টি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় চলে আসেই।
তার ভাষায়,
‘প্রায়ই অন্য আর দশটি দৃশ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অদৃশ্য আইনের তুলনামূলক মূল্যায়ন হয়৷ এরকম মূল্যায়ন তখনই সম্ভবপর এবং মূল্যবান হবে যদি অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো আইনকেও নিরপেক্ষ ভাবে বর্ণনা ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা হয় ৷ কিন্তু আধুনিক আইন ও সামাজিক বিজ্ঞানের কর্মপদ্ধতিই এমন যে বাস্তব অংশগ্রহণ ছাড়া তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব। এমনভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে যেন বাস্তবতার নিরিখে বোঝা যায় জনস্বার্থে কোনটি ভালো এবং সেই ভালো কাজ করার যৌক্তিকতা ( Reasonableness) কী /কোথায়। ‘ [1]
ভালো মন্দের (good) ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ একরকম হয় সত্যের ( exist) বেলায় আরেকরকম। প্রাকৃতিক আইন মতবাদের প্রকৃতি ও গুরুত্ব বুঝতে হলে পয়লা এর ভিন্নধর্মী যুক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে।দৃশ্যত এই ভিন্নধর্মী চিন্তার চর্চা থেকেই এই মতবাদের মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে।
প্রাচীন রোমান আইনজ্ঞ সিসেরো (Cicero) বৈরাগ্য দর্শন (Stoicism) আলোচনা করতে গিয়ে এমন তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন যা সর্বকালের প্রাকৃতিক আইন দর্শনের প্রধান উপাদান।
আইন আসলে প্রকৃতির সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার যুক্তি। এখানে ‘আইন’ সার্বজনীন, অপপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী…. এই ধরনের আইনের -পরিবর্তন পাপ, আংশিক রদ অনুমোদনযোগ্য নয় এবং সম্পূর্ণ বিলোপ করা অসম্ভব….. [স্রষ্টাই] হলেন আইনের প্রণয়নকারী, ঘোষক এবং তার প্রয়োগকারী বিচারক। [2]
…. সিসেরো
উল্লেখিত সেই তিনটি উপাদান হচ্ছে,
আইন –
- সার্বজনীন এবং অপরিবর্তনীয়
- সর্বোচ্চ অবস্থান
- যুক্তিলব্ধ ( এই অর্থেই প্রাকৃতিক)
সনাতন প্রাকৃতিক আইন মতবাদ (Classical Natural Law Theory) বিপ্লব ও তার প্রতিক্রিয়া দুটোরই যথার্থতা প্রমাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই কারণে প্রগতিশীল এবং রক্ষণশীল (Progressive and Conservative) উভয় শ্রেণীর চিন্তাধারারই এই মতবাদের দোহাই দিয়ে নিজেদের কাজকে বৈধতা দিয়েছে। খৃষ্ট-পূর্বাব্দ ৬০০ এর কাছাকাছি সময়ে গ্রিকরা মানুষের তৈরি আইন বর্ণনা করতে গিয়ে গুরুত্ত্ব দিয়েছে অদৃষ্টের। যা অনিবার্য তা ঠেকানো যাবেনা – এই চিন্তা বৈরাগ্যবাদীদের (Stoics) বলে মনে করা হয়। এই রক্ষণশীলতায় সবকিছুই ছিল ভাগ্যনির্ভর, এমনকি সেই সময়েও যা অন্যায় বলে মনে করা হতো সেটাও অনেক সময় ললাটে ছিল তাই হয়েছে এই অজুহাতে মেনে নিতে হতো। এর প্রায় হাজার বছরেরও বেশি সময় পরে পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি আইনের বিরোধের সম্ভাবনা দেখা যায়।
এরিস্টটল প্রাকৃতিক আইন প্রসঙ্গে তেমন কিছু বলেনন। তবে প্রাকৃতিক এবং প্রথাগত বিচারের পার্থক্য নির্ধারণে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলে। গ্রিক বৈরাগী দার্শনিকরাই (Greek Stoics) প্রাকৃতিক আইনের প্রথম দিকের কথা বলেছেন তারা ‘প্রাকৃতিক’ বলতে বুঝতেন যা যুক্তি দ্বারা লাভ করা যায়। কালক্রমে দর্শনের এই ধারা রোমানরাও বহন করেছে সিসেরোর লেখায় আমরা তা দেখেছি। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে যুক্তিহীন আইন (not in conformity with reason) যে অবৈধ এসময়কার লেখালেখিতে সেটা উঠে এসেছে।
তবে প্রাকৃতিক আইনের দর্শন পূর্ণাঙ্গ এবং আধুনিক হয় ক্যাথলিক চার্চ এর প্রভাবে। পঞ্চম শতকেই সেন্ট অগাস্টিন (St Augustine) ‘ন্যায়বিচার বিহীন রাষ্ট্র বৃহৎ লুটেরাদের দল’ এমন উক্তি করলেও মূলত ডমিনিকান[3] সেন্ট থমাস একুইনাসের (St Thomas Aquinas) (১২২৫-৭৪) লেখা Summa Theologiae তে প্রাকৃতিক আইন প্রসঙ্গে খৃষ্টীয় মতবাদ পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি চার ধরনের আইনের উল্লেখ করে এদের পরস্পর পৃথক করে দেখান। উল্লেখ্য আইন চারটি হলো:
- ১. চিরায়ত আইন (Eternal Law)
চিরকালের জন্য যে আইন। এই সকল আইনের কারণ, যুক্তি, যথার্থতা (Reason) ঈশ্বর মানুষের কাছে অবমুক্ত করেননি। বিতর্কের উর্ধ্বে অবস্থিত এই আইনের যৌক্তিকতা নেই তা নয়, কিন্তু শুধু স্রষ্টাই জানেন সেই যুক্তি (Reason)।
- ২. প্রাকৃতিক আইন
যে সকল চিরায়ত আইন শুধু যুক্তিবাদী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এই সমস্ত আইনের কারণ মানুষের বোধশক্তির উর্ধ্বে নয়।ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ যৌক্তিকতা (Reasonableness) দিয়ে সন্ধান করলে খুঁজে পাবে প্রাকৃতিক আইনের যথার্থতা।
- ৩. স্বর্গীয় আইন
এই আইন সরাসরি স্রষ্টা প্রদত্ত, প্রত্যক্ষ আইন ( Positive Law )। এর উৎস ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহ।
- ৪. মানবসৃষ্ট আইন
জনকল্যানের উদ্দেশ্যে মানুষের তৈরি আইন। এর যুক্তি এবং কারণও (Reason) মানবসৃষ্ট হবেই সেটা বলাই বাহুল্য।
একুইনাসের তত্ত্বের একটি বিষয় বর্তমানের বিশেষজ্ঞ দের মধ্যে দারুণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একুইনাস বলেছেন যদি কোন আইন প্রাকৃতিক অথবা স্বর্গীয় আইনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তবে তাকে আর আইন বলা যাবে না।
ল্যাটিন ম্যাক্সিম – ‘lex iniusta non est lex (an unjust law is not law) ‘ এ মূলত এই ভাবেরই সম্প্রসারণ ঘটেছে।
জুরিসপ্রুডেন্স (Jurisprudence) বিষয়ক সব লেখা পাবেন এখানে।
[1]It is often supposed that an evaluation of law as a type of social institution if it is to be undertaken at all, must be preceded by a value-free description and analysis of that institution as it exists in fact. But the development of modern jurisprudence suggests, and reflection on the methodology of any social science confirms, that a theorist cannot give a theoretical description and analysis of social facts, unless he also participates in the work of evaluation, of understanding what is really good for human persons, and what is really required by practical reasonableness.
[2] True law is right reason in agreement with Nature; it is of universal application, unchanging and everlasting. . . . It is a sin to try to alter this law, nor is it allowable to attempt to repeal any part of it, and it is impossible to abolish it entirely. . . . [God] is the author of this law, its promulgator, and its enforcing judge.
[3]Dominican -a member of the Roman Catholic order of preaching friars founded by St Dominic, or of a religious order for women founded on similar principles.