আপিল কি, কেন, কখন ও কিভাবে – দে. কা ১৮
বলা হয়ে থাকে মানুষ মাত্রই ভুলশীল আর এই মানুষ-ই যখন বিচার প্রক্রিয়ার প্রধান উপাদান তখন ভুলতো হতেই পারে। কোন পক্ষের ভুল বা সাক্ষ্য প্রমাণের ভুল বা আদালতের ভুল, আর এই ভুল ত্রুটিকে সঠিক পথ দেখানো প্রয়োজন। তাই আইনে রয়েছে নানান রকমের ব্যবস্থা তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল আপিল, রিভিউ ও রিভিশন। আর আজ আমরা এই লেখায় দেওয়ানী আপিল নিয়ে আলোচনা করবো।
আপিল কি?
সহজে বলতে গেলে আপিল হচ্ছে নিচের কোন আদালতের আদেশ, বিচার বা অন্য কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চতর আদালতে সেই বিষটি তুলে ধরা এবং আবেদনের মাধ্যমে যথোপযুক্ত বিচার চাওয়া।
অন্যভাবে বলা যায়, যখন কোন ব্যক্তি [নিম্ন] আদালতের ডিক্রি বা আদেশ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা সংক্ষুব্ধ হয় বা মনে করেন যে নিম্ন আদালতের রায়টি আইনত সঠিক বা যথোপযুক্ত হয় নি তখন সেই ডিক্রি, আদেশ বা রায়টি বাতিল পূর্বক সঠিক রায় চাওয়াই হচ্ছে আপিল।
মনে রাখতে হবে আপিল কিন্তু কোন অধিকার নয়, তার মানে যে কেউ চাইলেই আপিল করতে পারবে না, আপিল হচ্ছে বিশেষ সুযোগ।
আপিলের সাধারণ কিছু বিষয়
আপিল করতে হলে নিচের তিনটি উপাদান থাকতেই হবে
- ১. কোন একটি কোর্টের সিদ্ধান্ত
- ২. একজন ব্যক্তি (মামলার বাইরের কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হতে পারে)
- ৩. এমন কোন অফিস/ ব্যক্তি যিনি আইন দ্বারা আপনার আপিল শুনতে বাধ্য বা চাইলে শুনতে পারেন।
আমাদের আপিলের এই বিশেষ অধিকারটি আসে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, আরও স্পষ্ট করে বলা হলে ১০৩(২) তে বলা আছে,
- ক. সাংবিধানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজনে
- খ. মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতের আবেদনের কারণে
- গ. উক্ত (আপিল) বিভাগের অবমাননার কাড়নে
—- আপিলে-ট ডিভিশন, হাইকোর্ট ডিভিশনের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল শুনতে পারবেন।
এ ছাড়াও সংসদ দ্বারা পাশকৃত কোন আপনি আপিলের অধিকার দেওয়া থাকলে তাও শুনতে পারবেন।
আবার, ১০৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে বলা হয়েছে,
যেখানে ১০৩(২) দফা প্রযোজ্য নয় তারাও ইচ্ছে করলে আদালতে তাদের অভিযোগ আপিলের জন্য পেশ করতে পারবেন তবে এ ক্ষেত্রে এপিলেট ডিভিশন তা গ্রহণ করতে পারেন নাও করতে পারেন, একে বলা হয় Leave (Permission) to appeal
আমাদের দেশের অধিকাংশ আপিল হয়ে দেওয়ানী কার্যবিধি মেনে তাই দেওয়ানী কার্যবিধিতে বর্নিত আপিল প্রক্রিয়া নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হোল।
দেওয়ানী আপিল:
দেওয়ানী মোকদ্দমায় দু ধরনের আপিল হয়। ১। মূল ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল ও ২। আদেশের বিরুদ্ধে আপিল।
দেওয়ানী আপিল বুঝতে হলে আগে রায়, ডিক্রি ও আদেশ ভাল করে বুঝতে হবে, এগুলো বুঝতে এই লিংকটি অনুসরণ করুন: ডিক্রি, আদেশ এবং রায় কি ও এদের পার্থক্য
মূল ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল:
মূল ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিলে বিস্তারিত আলোচনা আছে দেওয়ানী কার্যবিধির ধারা ৯৬ থেকে ৯৯ পর্যন্ত এবং এর বিধান গুলো আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আদেশ ৪১ এ।
কে বা কারা আপিল করতে পারে?
- ১। ডিক্রি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ বা তার বৈধ প্রতিনিধি
- ২। রায় বা ডিক্রি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ গ্রহীতা।
- ৩। স্বার্থ আছে এমন যে কোন ক্ষত্মিস্থ ব্যক্তি আদালতের অনুমতি নিয়ে।
- ৪। নাবালকের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক নিযুক্ত আইনগত অভিভাবক।
কোন কোন ক্ষেত্রে এই আপিল চলবে? [ধারা, ৯৬]
- ১। মূল এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের প্রত্যেক ডিক্রি বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। [৯৬(১)]
- ২। একতরফা ভাবে প্রদও মূল ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল চলবে। [৯৬(২)]
কখন আপিল চলবে না? [ধারা, ৯৬ ও ৯৭]
- পক্ষগণের সম্মতির ভিত্তিতে প্রদত্ত ডিক্রি অর্থাৎ সােলে ডিক্রির (Compromise Decree) বিরুদ্ধে। [ ৯৬(৩)]
- ক্ষুদ্র বিষয়ক আদালতের ডিক্রির বিরুদ্ধে।
- নির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার অধীনে প্রদত্ত আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
- প্রাথমিক ডিক্রি থেকে আপিল না করলে সেই বিষয়ের চুড়ান্ত ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। [ ৯৭]
কিভাবে দেওয়ানি আপিল করতে হবে?
- ১। দেওয়ানি আপিল স্মারকের (Memorandum) আকারে আদালতে রুজু করতে হবে। [বিধি-১, আদেশ-৪১]
- ২। প্রত্যেক আপিলে স্বাক্ষর করবে আপিলকারী বা তার উকিল। বিধি-১, আদেশে ৪১]
- ৩। আপিলের স্মারকলিপির সাথে ১টি করে ডিক্রি বা রায়ের নকল প্রদান করতে হবে। বিধি ১, আদেশ ৪১]।
- ৪। দেওয়ানি আপিলের মেমােতে কোন একটি কারণ উল্লেখ না করলে, শুনানীকালে তা উত্তাপন করা যাবে শুধুমাত্র আপিল আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে। [বিধি-২, আদেশ-৪১]
- ৫। আইনে আপিলের বিধান উল্লেখ না থাকলে আপিল করা যায় না।
আদেশের বিরুদ্ধে আপিল
ধারা- ১০৪, ১০৬ এবং আদেশ ৪৩
- ১। ৩৫ক ধারার আওতায় প্রদত্ত আদেশ।
- ২। ৯৫ ধারার আওতায় প্রদত্ত আদেশ।
- ৩। ডিক্রি জারিতে গ্রেফতার বা দেওয়ানি কারাগারে আটকের আদেশ ছাড়া এই আইনের | যে কোন বিধানের আওতায় জরিমানার বা কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা দেওয়ানি কারাগারে আটক করার নির্দেশমূলক আদেশ।
- ৪। যেখানে নিয়মাবলীর দ্বারা আপিল ব্যক্তভাবে মঞ্জুর করা হয়।
দেওয়ানী আপিল কোন আদালতে ও কত দিনের মধ্যে করতে হবে
আদালত
দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ [The Civil Court Act,1887] এর ২১ ধারা অনুসারে;
১। সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ এবং যুগ্ম-সহকারী জজ আদালতের ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করতে হবে জেলা জজের আদালতে।
২। যুগ্ম জেলা জজের ডিক্রি বা আদেশের মূল্যমান ৫ লক্ষ অধিক হলে আপিল দায়ের করতে হবে হাইকোর্ট বিভাগে।
সিভিল কোর্ট অ্যাক্ট, ২০১৬ সালে সংশোধনীর ফলে বর্তমানে আপিল এখতিয়ার ৫ লক্ষের পরিবর্তে ৫ কোটি টাকা অধিক হলে আপিল করা হবে হাইকোর্ট বিভাগে। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এটি এখানো কার্যকর করা হয়নি।
৩। জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতের রায় বা ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল যাবে হাইকোর্ট বিভাগে।
তামাদি
১। জেলা জজের নিকট কোন রায় ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে।
[অনুচ্ছেদ ১৫২, তামাদি আইন ১৯০৮]।
২। হাইকোর্ট বিভাগে কোন রায় ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় ৯০ দিনের মধ্যে।
[অনুচ্ছেদ ১৫৬, তামাদি আইন ১৯০৮]
- দেওয়ানী কার্যবিধির সকল বিষয় দেখুণ।
- বার কাউন্সিল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ঘুরে আসুন: বার কাউন্সিল পরীক্ষার প্রস্তুতি (সকল বিষয়) পাতা থেকে।
- আরো দেখুন: দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ২২, ২৩ এবং ২৬ – দে. কা. ১৬ এবং
- রেফারেন্স, রিভিউ এবং রিভিশন
আমাদের সকল লেখা ও আপডেট পেতে সাবসক্রাইব করুন [ডানদিকে নিচের লাল বেল বাটনটি ক্লিক করুন] অথবা আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে রাখুন।
আপিল করতে কত টাকা খরচ?
আপনি আপিল কোথায় করবেন, কোন বিষয় করবেন, কেমন উকিল দিয়ে করাবেন ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে।