তালাক দেয়ার সঠিক নিয়ম
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ বৈবাহিক জীবনের ঝগড়াঝাঁটিতে একটা কমন শব্দ, এমন কোন বিবাহিত ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর যে তালাকের কথা ভাবে না । দৈনন্দিন জীবনে এই ভাবনাটা কারো কারো জন্য প্রয়োজনের রূপ ধারণ করে। কেউ হয় বাঁচার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ করে আবার কেউবা নিজের স্বাধীন জীবন ফিরে পাবার জন্য, কিছু ক্ষেত্রে স্বার্থের জন্যও তালাক হয়। সে যাই হোক, ভাল-মন্দ বা স্রেফ কৌতূহলে হলেও তালাক সম্পর্কে জেনে রাখা ভাল। হয়তো কারো উপকার হতে পারে।
তালাক
তালাক শব্দের অর্থ হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থাৎ যার মাধ্যমে বিবাহের সম্পর্ক বিলুপ্ত হয়। স্বামী – স্ত্রী তাদের অধিকার ও কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পান। তারা চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন, নতুন করে ঘর সংসার করতে পারেন।
দেনমোহরর বিষয়ে আরও বিস্তারিত দেখুন এখানে : দেনমোহর; সমস্যা ও সমাধান
মুসলিম আইন ও বাংলাদেশের আইন
একজন ব্যক্তির বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ ইত্যাদি তারা ব্যক্তিগত বা ধর্মীয় আইন অনুসারে হয় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সরকার সেই ব্যক্তিগত আইনের পাশাপাশি কিছু রাষ্ট্রীয় আইনও প্রয়োগ করেন যা কোন ব্যক্তি না মানলে তারা সাজা বা জরিমানা হয়। মুসলিম আইনে তালাক হচ্ছে এমন একটি কাজ যা হালাল কিন্তু তার মধ্যে নিকৃষ্ট তাই এই বিষয়টিতে সর্তকতার সাথে আগানো জরুরী যাতে করে কোন ভুল হয়ে না যায়।
প্রসঙ্গত, মুসলিম আইনে বিয়ে হচ্ছে একটি দেওয়ানী চুক্তি যেখানে স্ত্রীকে দেনমোহরের বিনিময়ে তার স্বামী বিয়ে করেন। এবং স্বামী স্ত্রীর সকল দায়িত্ব নেন।
এই বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার না, তাছাড়া কিছু আলেম – ওলামা যথেষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান রাখলেও রাষ্ট্রীয় জ্ঞান না থাকায় তাদের মতামত ও ফতোয়া কিছু বিষয় আরও ঘোলাটে করেন। ফলে সাধারণ মানুষ না বুঝে কনফিউর্জড হয়ে যান, বিপদে পরেন।
আজ আমরা বাংলাদেশের আইনের আলোকে মুসলিমদের তালাকের নিয়ম দেখব।
তালাক বা ডির্ভোস দেয়ার সঠিক নিয়ম ও আইনি প্রক্রিয়া
কে কাকে তালাক দিতে পারে
স্বামী দ্বারা স্ত্রীকে তালাক
একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যে কোন সময় কোন করার ছাড়াই তালাক দিতে পারে। এর একটি কারণ হচ্ছে মুসলিম আইনে বিয়ে একটি দেওয়ানী চুক্তি, যেখানে দেনমোহরের বিনিময়ে একজন মেয়েকে একজন ব্যক্তি তার স্ত্রী করে। দেনমোহরের সকল অর্থ প্রদান সাপেক্ষে [প্রদান করবে এই মর্মে] একজন মুসলিম স্বামী কোন শর্ত বা কারণ ছড়াই তালাক প্রদান করতে পারে।
স্ত্রী দ্বারা স্বামীকে তালাক
মুসলিম আইন দ্বারা স্ত্রী নিজ ক্ষমতা বলে স্বামীকে তালাক দিতে পারে না, তবে স্বামী যদি বিয়ের সময় স্ত্রীকে তালাকে ক্ষমতা অর্পণ করে তবে স্ত্রী নতুন করে কোন অনুমতি ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারে। এটাকে মুসলিম আইনে বলে তালাক-ই-তৌফিজ।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারী বিবাহ রেজিস্ট্রি বইতে এই বিষয়টা সহজ করার জন্য একটা ঘর; ১৮ নং ঘর বিশেষ ভাবে রাখা হয়েছে। তাছাড়াও মুসলিম আইন অনুযায়ী সমঝোতার মাধ্যমে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী তালাক পেতে পারেন, খুলা তালাক ও মুবারাত তালাকে মাধ্যমে।
এ ছাড়াও মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ অনুযায়ী কোন স্ত্রী কারণ দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারে। এই বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত পাবেন এখানে: মুসলিম স্ত্রীর দ্বারা তালাক ও আইন
কে তালাক দিবে ও কিভাবে তালাক দিবে তা বের করার পর তালাকের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয় এটা কম বেশী ৩-৪ মাসের প্রক্রিয়া, চলুন বিষয়টা বিস্তারিত দেখি।
তালাক প্রক্রিয়া
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুসারে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করার জন্য অপর পক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হয়, লিগ্যাল নোটিশ পাবার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন মেয়রে ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সালিসি পরিষদ গঠন করবেন এবং প্রতিমাসে একবার করে পর পর তিন মাস সালিশের মাধ্যমে বিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন বা অন্য কোন বিষয় (যেমন, দেনমোহর) সমাধান করার চেষ্টা করবেন। যদি বিষয়টা সমাধান না হয় তবে তালাক কার্যকর হবে। নিচে আরও বিস্তারিত ভাবে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হল।
লিগ্যাল নোটিশ
তালাক দেয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয় তালাকের নোটিশের মাধ্যমে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৭ (১) অনুসারে স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দেকনা কেন, যে প্রক্রিয়াই তালাক দেকনা কেন তাকে অপর পক্ষকে তালাকের নোটিশ প্রদান করতে হবে।
কাকে ও কোথায়
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৭ (১) অনুসারে অপর পক্ষ (যাকে তালাক দেওয়া হচ্ছে) যেখানে বসবাস করেন সেই স্থানের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন মেয়রের নিকট তালাকের নোটিশ প্রেরণ করতে হবে। তাছাড়াও এই নোটিশের একটি কপি অপর পক্ষের নিকট প্রদান করাতে হবে।
কিভাবে
নোটিশটিতে তালাক প্রদানের ব্যাপারে উল্লেখ থাকবে, কোন আইনে নোটিশ পাঠাচ্ছেন তা উল্লেখ থাকবে, তালাক প্রদানকারীর সাক্ষর থাকবে, দুইজন সাক্ষীর সাক্ষর থাকবে। তালাকের নোটিশ আইন অনুসারে পাঠালেই হয়, এটি নিজে অথবা একজন কাজীর দ্বারা অথবা একজন আইনজীবী দ্বারা প্রেরণ করা যায়। এই বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। একজন উকিল দ্বারা নোটারি করে নোটিশটি পাঠান উত্তম সে ক্ষেত্রে আইনগত কিছু বিষয়ে পরবর্তীতে সুবিধা পাওয়া যায়। তাছাড়া একজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ রাখলে আপনি ভবিষ্যতে কি ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন তা জানবেন ও আগে থেকে বুঝে শুনে আগাতে পারবেন।
নোটিশটি রেজিস্টার্ড পোষ্টের মাধ্যমে দেওয়া উত্তম। মৌখিক ভাবে নোটিশ দিলে সেটা আইনগত ভাবে হবে না।
নোটিশ না প্রদান করলে
আইনে নোটিশ প্রদান করার কথা বলা আছে তবে কেউ নোটিশ প্রদান না করেও তালাক প্রদান প্রদান করতে পারবে কিন্তু সেক্ষেত্রে নোটিশ প্রদান না করার জন্য তাকে সাজা পেতে হবে, এটা হতে পারে সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়।
নোটিশ গ্রহণ না করলে
নিয়ম হচ্ছে তার সর্বশেষ বসবাসের ঠিকানায় নোটিশ প্রেরণ করতে হবে। এটুকুই তালাক দাতার জন্য যথেষ্ট। অপর ব্যক্তি যদি নোটিশ গ্রহণ না তাতে কোন সমস্যা নেই। আইন ধরে নেবেন তিনি নোটিশ পেয়েছেন।
নোটিশ প্রত্যাহার
যদি নোটিশ দাতা মনে করেন তিনি তালাক চান না তবে তিনি ৩ মাসের মধ্যে আরও একটি নোটিশ প্রেরণ করে তার আগের নোটিশ টি প্রত্যাহার করতে পারবেন।
সালিশ পরিষদ
উপরিউক্ত নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান সালিশ পরিষদ গঠন করবে। এই সালিশ পরিষদে থাকবেন একজন চেয়ারম্যান, দুই পক্ষে একজন করে দুই জন সদস্য। তাছাড়াও দুই পক্ষের শুভাকাঙ্ক্ষী ও আত্বিয় পরিজন সালিশে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। এবং চাইলে সালিশ পরিষদ কোন বিষয়ে জানতে চাইতে পারে এমন কি সাক্ষ্য প্রমাণও গ্রহণ করতে পারে কিন্তু আইনগত ভাবে এগুলোর বিশেষ কোন মূল্য নেই।
সালিশ পরিষদ চাইবে যেন বিবাহ বিচ্ছেদ না হয়। তবে যদি কোন একপক্ষ চায় বিচ্ছেদ হোক তবে সালিশ পরিষদের কিছু করার থাকবে না। যে কোন পক্ষ সালিশ পরিষদে তাদের প্রতিনিধি নাও দিতে পারে এবং অংশগ্রহণ না-ও করতে পারে। এমন ভাবে পর পর তিন মাসে যদি সালিশি পরিষদের মাধ্যমে দুই পক্ষ কোন সমাধান (তালাক বাতিল) না করতে পারে তবে তালাকটি কার্যকর হবে। ধরে নেওয়া হবে যেই দিন তালাকের নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হয়েছে। আর যদি তাদের মধ্যে আপোষ হয় তবে তালাকটি আর হবে না।
ইদ্দত ও ভরণপোষণ
তালাক প্রক্রিয়া চলাকালীন এই সময় (৩মাস /৯০ দিন) স্ত্রীর জন্য ইদ্দতের সময় এই সময়ে স্বামী- স্ত্রীর সকল ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন। ইদ্দত সময়টিতে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে স্ত্রী গর্ভবতী, তবে সেই গর্ভাবস্থার অবসান না হওয়া পর্যন্ত বা বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করে কেন এই ৩ মাস সময়, এর একটি উত্তর হচ্ছে এই সময়টা দেয়া হয় আপোষ করার জন্য যাতে কোন ভুল বোঝাবোঝি বা আবেগের কারণে তালাক না হয়, আরও একটি কারণ হচ্ছে ইদ্দতের সময়টাতে স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হলে তা ধরা পরে এবং একটি জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
তালাক নিবন্ধন / তালাকের সনদ
সালিশ পরিষদের মীমাংসা চেষ্টায় যদি তারা বিবাহ বিচ্ছেদে ঠেকাতে সফল না হয় তবে তালাক কার্যকর হবে। কিন্তু এই তালাকে বিষয়টি আবার নিবন্ধন করতে হবে। যে পক্ষ তালাক দিবেন সেই পক্ষ তারা এলাকার বিবাহ (নিকাহ) ও তালাক রেজিস্টারের (কাজী) কাছে গিয়ে তালাকে বিষয়টা অবহিত করবেন, এবং তখন নিকাহ রেজিস্টার বিষয়টা সত্য বলে উপলব্ধ হলে তালাকটি The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 এর ৬ ধারা অনুযায়ী নিবন্ধন করবেন। এবং তিনি এই নিবন্ধনের একটি সত্যায়িত অনুলিপি প্রদান করবেন।