উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার; বণ্টন সমস্যা ও সমাধান [অংক সহ]

একজন মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার সম্পত্তি কোরানিক আইন অনুসারে তার ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন হয়। এই আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছে। তবে কন্যার সম্পত্তি বন্টনের বিষয়ে কখন কতটুকু পাবে ও কিভাবে পাবে তা নানা বিষয়ের ও শর্তের উপর নির্ভরশীল তাই এই বিষয়টা অনেকে সঠিক ভাবে বোঝেন না বা ভুল ধারনা নিয়ে থাকেন যা আমি আজ সহজ ভাবে প্রকাশ করব।

একজন মুসলিম ব্যক্তি বাংলাদেশে কন্যা সন্তানের সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে নানান ধরনের ভুল ধারনা রয়েছে যেমন,

  • ভাই না থাকলে বোনরা সম্পত্তি পায় না,
  • সম্পত্তি চাচাতো ভাইরা পায়,
  • মায়ের সম্পত্তি মেয়েরা বেশি পায়,
  • মেয়েরা বসতভিটিা পায় না ইত্যাদি।

এই লেখা আমরা এই বিষগুলো একটা একটা করে পরিষ্কার করব এবং কিছু সমস্যার সমাধান ও উল্লেখ করব। তবে বিষয়গুলো বুঝতে হবে প্রথমেই আমাদের মুসলিম উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের প্রাথমিক বিষয় গুলো ও প্রক্রিয়াগুলো জানতে হবে। তাই প্রথমেই আমাদের এই লেখাটি: মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টন (গাণিতিক সমাধান সহ) এবং সেখানে সংযুক্ত ভিডিওটি দেখে আসুন। এবার চলুন দেখি একজন কন্যা বা মেয়ে কিভাবে তার বাবা বা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পায়।

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কন্যার অধিকার

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কন্যার অধিকার

একজন কন্যা বা মেয়ে কিভাবে তার বাবা বা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পায়

পুত্র (কন্যার ভাই)থাকলে:

একজন কন্যা বা মেয়ে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে যদি কন্যার কোন ভাই থাকে তবে ভাইয়ের সাথে রেসিডিউয়ারি বা অবশিষ্ট ভোগী হিসাবে ভাগ পায়। সেখানে ভাই ও বোনের অনুপাত হয় ২:১।

তাহলে উদাহরণ স্বরূপ যদি ধরি, ১ ভাই ও ১ বোন তবে তাদের সম্পত্তি বণ্টনের অনুপাত হবে; ১ ভাই = ২ ভাগ, ১ বোন = ১ ভাগ; মোট: ২+১= ৩ ভাগ। তার মানে হয় মোট সম্পত্তি ৩ টি ভাগ হবে এবং তার ২ ভাগ পাবে ভাই ও বাকি এক ভাগ পাবে বোন।

চলুন আরো একটি উদাহরণ দেখি; ধরি ৩ ভাই ও দুই বোন। এখানে; নিম্নরূপে সম্পত্তিটি ভাগ হবে,

  • ১ম ভাই = ২ ভাগ
  • ২য় ভাই = ২ ভাগ
  • ৩য় ভাই = ২ ভাগ
  • ১ম বোন= ১  ভাগ
  • ২য় বোন = ১ ভাগ

মোট: ৮ ভাগ;  এখানে  সম্পত্তিটি ৮ টি ভাগ হবে এবং প্রত্যেক ভাই ২ ভাগ করে পাবে এবং প্রত্যেক বোন এক ভাগ করে পাবে।

বিষয়টি বোধগম্য না হলে দয়া করে  মুসলিম উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আমাদের আগের পোষ্ট ও ভিডিওটি দেখুন।

কন্যা বা কন্যাগন থাকলে

শুধুমাত্র একজন কন্যা থাকলে সে শেয়ারর বা অংশীদার হিসাবে  পিতা-মাতার সম্পত্তির ১/২ অংশ বা অর্ধেক অংশ পাবে আর যদি একের অধিক কন্যাগণ থাকে তবে তারা সকলে মিলে শেয়ারর হিসাবে ২/৩ বা দুই তৃতীয়াংশ পাবে।

চলুন একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝি;

ধরি,  সকিনা ও করিমা দুই বোন, তাদের বাবা ১ লক্ষ টাকা রেখে গেছে। এখন তারা যেহেতু দুই কন্যা (পরস্পরের দুই বোন) সেহেতু তারা একত্রে এক লক্ষ টাকার ২/৩ অংশ পাবে। এখন এটা বের করার সহজ উপায় হচ্ছে ১ লক্ষকে ৩ দিয়ে ভাগ দেওয়া এবং তারপর তা দুই দিয়ে গুন করা। তাহলে তারা দুই বোন এক সাথে পায় ৬৬.৬৬ হাজার টাকা এবং এটা আবার সমান ভাগে ভাগ করলে তারা প্রত্যেকে পায় ৩৩.৩৩ হাজার টাকা।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে বাকি ৩৩.৩৩ হাজার টাকা কোথায় গেল?

উত্তর হচ্ছে, রেসিডিউরি বা অবশিষ্ট ভোগীদের কাছে।

যখন ভাই  বা ভাইয়ের ছেলেরা সম্পত্তি পায়

আপনারা জানেন যে, যদি মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র সন্তান না থাকে তবে কন্যা বা কন্যাদের  শেয়ারর হিসাবে তাদের প্যাপ্য অংশ দেওয়ার পরও কিছু সম্পত্তি থেকে যায় এই সম্পত্তিটা পায় যারা রেসিডিউয়রি বা অবশিষ্ট ভোগি হিসাবে থাকে তারা। তাই যদি কোন ব্যক্তি এক বা একাধিক কন্যা রেখে মৃত্যুবরন করেন এবং মৃত ব্যক্তির বাবা -মা, দাদা-দাদি কেউ বেঁচে না থাকে তখন মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন বা ভাইয়ের ছেলেরা সম্পত্তি পায়।

অন্য ভাষায় বলতে গেলে  কন্যার ভাই না থাকলে কন্যার চাচা – ফুফ বা তারা না থাকলে চাচার সন্তান তাথা চাচাতো ভাইরা সম্পত্তি পায়। তবে অবশ্যই এখানে কিছু নিয়ম অনুসারে পায়।  এখন চলুন অবশিষ্টভোগিরা কিভাবে সম্পত্তি পায় তা দেখে নেই।

রেসিডিউরি বা অবশিষ্ট ভোগীর মাঝে সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম

অবশিষ্ট ভোগীদের ক্রম অনুযায়ী চার শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, এখানে এক শ্রেণীর ব্যক্তিগণ পেলে অন্য শ্রেণীর কেউ আর পাবে না। অথ্যাৎ, নিজ নিজের বংশধর পেলে আর পূর্ববর্তী বংশধর পাবে না। আবার নিজের বংশধর না থাকলে  পূর্ববর্তী বংশধর পাবে কিন্তু  পিতার বংশধর থাকলেও তারা পাবে না। প্রতি লিস্টের যত জন থাকবে তারা প্রত্যেকেই সমান ভাবে সম্পত্তি পাবে (তবে সেই সম্পর্কের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক থাকলে ২: ১ হারে পাবে)।

  • ১। নিজের বংশধর: পুত্র, কন্যা [প্রতিনিধিত্ব নীতি পুত্রের সন্তান থাকলে বা  কন্যার সন্তান থাকলে তারা]
  • ২। পূর্ববর্তী বংশধর: পিতা, দাদা।
  • ৩। পিতার বংশধর: ভাই, বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈমাত্রেয় ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলে, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের ছেলে।
  • ৪। দাদার বংশধর: চাচা, বৈমাত্রেয় চাচা, চাচার ছেলে, বৈমাত্রেয় চাচার ছেলে, চাচার ছেলের ছেলে, বৈমাত্রেয় চাচার ছেলের ছেলে, আরো দূরবর্তী বংশধর।

এখন বাস্তব ভিত্তিক ভাবে দেখা যায় মৃত ব্যক্তির বাবা-মা খুব কম সময়েই বেচে থাকেন, সাধারণত ভাই-বোন বা ভাতিজারা বেঁচে থাকেন। এ ক্ষেত্রে (মৃত ব্যক্তির) ভাই-বোনরাই সম্পত্তি পান কিন্তু ভাই-বোনরাও বেঁচে না থাকলে তখন ভাতিজারা পান। আর তারা পেলেও খুব বেশি একটা আসলে পান না।

চলুন একটা বাস্তব ভিত্তিক উদাহরণ দেখি তাহলে বিষয়টা সহজেই বুঝা যাবে।
ধরি, “ক” মৃত ব্যক্তি ১ স্ত্রী, ২ ভাতিজা, ২ মেয়ে রেখে মৃত্যু বরন করেছেন। তিনি ১ লক্ষ টাকা রেখে গেছেন; এখানে কে কত অংশ পাবেন?

Calculation 01

এখানে প্রথমে শেয়ারারদের অংশ বের করতে হবে। যেখানে, স্ত্রী পাবেন: ১/৮ অংশ; ২ মেয়ে একত্রে পাবেন: ২/৩ অংশ; অতএব মা ও মেয়রা একত্রে পাবেন, 1/8 + 2/3 = 3+16/24 = 19/24; অংশ।

 

Calculaiton 02

এখন এই অংশটা যদি আমরা সম্পূর্ন অংশ থেকে বাদ দেই তাহলে রেসিডিউরি হিসাবে ভাতিজারা (দুই জন মিলে) কতটা পাবে তা বের হয়ে যাবে। আমরা একটি সম্পূর্ন সম্পত্তিকে ১ ভাগ ধরি, তাই 1 থেকে 19/24 বাদ দিতে হবে।

তাহলে বাকি থাকে, 119/24 = 24-19/24 = 5/24 অংশ 

এইবার আমরা এক এক করে প্রত্যেকের অংশ বের করি,

  • স্ত্রী পাবে ৩/২৪ অংশ, অতএব তিনি ১ লক্ষ টাকা থেকে পায় ৩/২৪*১০০০০০ = ১২,৫০০  টাকা।
  • দুই বোন পাবে ১৬/২৪ অংশ, অতএব তারা ১ লক্ষ টাকা থেকে পায় ১৬/২৪*১০০০০০ = ৬৬,৬৬৬ টাকা, এবং প্রত্যেক মেয়ে পায় ৩৩,৩৩৩ টাকা।
  • দুই ভাতিজা পাবে ৫/২৪ অংশ, অতএব তারা ১ লক্ষ টাকা থেকে পায় ৫/২৪*১০০০০০ = ২০৮৩৩ টাকা এবং প্রত্যেক ভাতিজা পায় ১০৪১৬ টাকা।

তো আমরা এই অংকের হিসাব থেকে দেখলাম যে, যদি ভাই বা ভাতিজারা পায়ও তারা খুব বেশি সম্পত্তি আসলে পায় না, মৃত ব্যক্তির পুত্র না থাকলেও কন্যারা একটা ভালো অংশের সম্পত্তি পায় এবং অল্প কিছু অংশ রেসিডিউরি হিসাবে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন বা ভাতিজারা পেতে পারে। তবে কেউ কেউ এই সম্পত্তি দেওয়া পক্ষপাতী নন তাই তারা অবশ্য বেশি কিছু উপায় গ্রহণ করতে পারেন।

ভাতিজাদের সম্পত্তি না দিতে চাইলে কি করবেন?

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যদি পুত্র না থাকে, পিতা না থাকে, দাদা না থাকে, ভাইবোন না থাকে কিন্তু ভাতিজা / ভাইয়ের ছেলে থাকে তবে তারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির একটা অংশ রেসিডিউরি হিসাবে পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই সম্পত্তি না দিতে চাইলে যার সম্পত্তি তার মৃত্যুর আগেই তাকে তার কন্যাদের সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে হবে। কয়েকটি প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করা যায়।

১। বিক্রয় দলিলের মাধ্যমে;  এটা সবচেয়ে ভালো পন্থা, এই পন্থায় একটা বিক্রির সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, সরাসরি সম্পত্তি হস্তান্তর হয় যার ফলে পরে আর কোন হস্তান্তরের সমস্যা হয় থাকে না। তবে এ ক্ষেত্রে দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে খরচের পরিমাণটা অনেক বেড়ে যায় তাই সাধারণত মানুষ এই পন্থা অবলম্বন করেন না।

২। ইচ্ছাপত্র বা উইলের মাধ্যমে; এটাও একটা ভালো পন্থা করান এই পদ্ধতিতে যিনি দান করবেন তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সম্পত্তি তার দখলে থাকে, তিনি চাইলে তার উইল বাদ করতে পারেন এবং এটা রেজিস্ট্রেশন করার ঝামেলা নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এই যে, যিনি দান করবে তিনি তার মোট সম্পত্তির ১/৩ এর বেশি অংশ দান করতে পারবেন না।

৩। মুসলিম হেবার (দান) করে; এই ক্ষেত্রে শর্তহীন ভাবে দান হতে হবে। এটার সুবিধা হল এটি নগদে হস্তান্তর হয়, ভবিষ্যতে ঝামেলা কম হয় এবং এতে রেজিস্ট্রেশন খরচ খুব-ই কম। তাই সাধারণত মানুষ এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে বেশি আগ্রহী হয়।

অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে উপরের ১ ও ৩ নং পদ্ধতিতে সম্পত্তি একবার বুঝিয়ে দিলে কিন্তু তা সহজ পন্থায় ফেরত পাওয়ার আর কোন উপায় নেই তাই কাজটি অবশ্য ভেবে -চিন্তে, বুঝে-শুনে করতে হবে।

 ভুল ধারনা

এই বিষয়টি ছাড়াও আমাদের সমাজে আরো দুটি প্রচলিত ভুল ধারনা আছে যে,

১। মেয়েরা মায়ের সম্পত্তি বেশি পায়, আদতে তেমন কোন আইন নেই।

২। মেয়েরা বাবার বাড়ি / ভিটা পায় না।

এখানে সাধারণত যুক্ত পরিবার থাকলে এবং এক বাড়িতে সবাই বসবাস করলে বাড়িতে যারা অবস্থান করে তাদের সেই সম্পত্তির উপর দখল থাকে তাই এই ধারনার উৎপত্তি, তাছাড়াও কন্যাদের বিয়ে হয়ে গেলে সাধারণত তারা শশুর বাড়ীতে থাকে তাই এই ধারনার উৎপত্তি কিন্তু আইনে বাড়ি বা ভিটার ভাগ পাবে না এমন কোন কথা বলা নেই।

আশা করি এই লেখাটি দ্বারা বা -মায়ের সম্পত্তির কন্যা বা মেয়ে সন্তানের অধিকার, সম্পত্তি বণ্টন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারনা প্রদান করতে পেরেছি। এ ধরনের যে কোন সমস্যা সামাধানের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!