আদালত বর্জন ও বিচারককে বিচারকার্যে বাধা; অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
প্রায় সময়েই দেশের অধস্তন আদালতে বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির সিদ্ধান্তে আদালত বর্জন এর ঘটনা ঘটে । এটা আমাদের দেশে মোটেও নতুন কিছু নয়। এই বর্জনের কারণ অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু তা মোটেও কাম্য নয়। এই আদালত বর্জনের পরে সংশ্লিষ্ট বিচারক কে বিচার কার্যে বসতে বাধা দিতেও দেখা গেছে! যা বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পথে অন্যতম একটা বাধা । একইসাথে এটা যেমন অসাংবিধানিক, বেআইনি তেমন অপরাধ। শুধু তাই নয় এর ফলে অন্যের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ও লঙ্ঘন হতে পারে
কারণ:
১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “আইনানুগ পন্থা ব্যতীত কারো সম্পদ, স্বাধীনতা,জীবন এবং সুনাম ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।” কিন্তু কোর্ট বর্জন হল সংশ্লিষ্ট বিচারকের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার বেআইনি পন্থা। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। অর্থাৎ কোর্ট বর্জনের মতো বেআইনি সিদ্ধান্ত স্পষ্টত বিচারকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ এর লঙ্ঘন।
২। আদালত বর্জন করেন কতিপয় আইনজীবী যাতে বেশিরভাগ সময় ই উক্ত বারের সকল আইনজীবীর সম্মতি থাকেনা। একই সাথে একটা জেলার দূর দূরান্ত থেকে বিচার প্রার্থীগণ বিচার পেতে আদালতে আসেন (ক্ষেত্র বিশেষে এক জেলা থেকে অন্য জেলাও যেতে হয় – যেমন যেসব বিভাগে একটা মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল) কিন্তু এতদূর থেকে এসে তারা আদালত বন্ধ পেয়ে হয়রানি ব্যতীত কিছুই হন না! একইসাথে আইনজীবী দের কাজের উপর নির্ভরশীল থাকা মোহরা বা সহকারীগণ এর আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিচার প্রার্থী জনগণ, অন্যান্য আইনজীবী এবং আইনজীবী সহকারীদের জীবিকার উপর মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলে। ফলে তাদের জীবন, সম্পত্তি স্বাধীনতা ব্যাহত হতে পারে যেটাও সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
৩। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের অন্যতম মুল লক্ষ হিসেবে মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, সমতা ও ন্যায়বিচার এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যখন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালত বর্জন করা হয় তখন সেটা সেই লক্ষ এর উপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আইনের শাসন বা রুল অব ল এর অন্যতম একটা প্রিন্সিপাল হল “Be you ever so high, the law is always above you” অর্থাৎ আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা যাবে হোক তিনি বিচারক বা আইনজীবী বা সাধারণ মানুষ অথবা অন্য কেউ! বিচারক যদি দুর্নীতি করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
৪। আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে একজন বিচার প্রার্থীর দ্রুত বিচার পাওয়াটা তার মৌলিক অধিকার। তাই আদালত বর্জন করে আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত করা একজন বিচার প্রার্থীর মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনের সামিল।
এবার আসি আইনজীবীদের জন্য প্রণীত “বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস্ এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২” এ….
এই আইনের “আদালতের প্রতি কর্তব্য” অধ্যায়ের ১ম দফায় বলা হয়েছে যে, “বিচারকরা যেহেতু অহেতুক ও অসার বিষাদগারের প্রতি আত্মরক্ষায় দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন না বা নিজেকে ডিফেন্ড করে কোন কথা বলতে পারেন না তাই বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে আদালতের প্রতি শ্শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগী হতে হবে”। এখানে আরো বলা হয়েছে যে ” কোন বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী আইনানুগ ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা টা হল মাননীয় প্রধান বিচারপতি বা আইন সচিব বা জেলা জজের কাছে লিখিত দরখাস্ত দিয়ে অভিযোগের বিস্তারিত বর্ণনা করে তার প্রতিকার চাইতে হবে। সেটা না করে কোর্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বেআইনি। এতে সংশ্লিষ্ট বিচারকের শুধু মানহানি ই হয়না বরং আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভের যে মৌলিক অধিকার সেটাও লঙ্ঘন করা হয়।
আদালত বর্জন শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিনা?
বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস্ এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এর ”আদালতের প্রতি কর্তব্য” অধ্যায়ের প্রথম দফা লঙ্ঘন করে “ বিচারকের বিরুদ্ধে গিয়ে আদালত বর্জন করাটা উক্ত অর্ডারের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পেশাগত অসদাচরণ যা শাস্তিযোগ্য, যার ফলে উক্ত আইনজীবীর বিরুদ্ধে তিরস্কার বা পেশা পরিচালনা থেকে সাময়িক বরখাস্ত বা সনদ বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
দণ্ডবিধির ২১ ধারা অনুযায়ী বিচারক গণ সরকারি কর্মকর্তা, তাই বিচারক কে সরকারি দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেওয়া দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৮৬ ধারা অনুযায়ী অপরাধ ।
যদি বিচারককে বিচার কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দেয়া হয় তাহলে সেটা দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধ । একইসাথে উক্ত আইনের ২২৮ ধারা অনুযায়ী বিচারকার্যে নিয়োজিত কোন সরকারি কর্মকর্তাকে বিচার কাজে ইচ্ছাকৃত দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়াটা অপরাধ। অর্থাৎ এই কোর্ট বর্জনের সংস্কৃতির কোন আইনগত ভিত্তি নাই। পুরোই বেআইনি এবং একটি অপরাধমূলক কাজ।
কোর্ট বর্জনের এই সংস্কৃতি যাতে কারো ব্যক্তি স্বার্থে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আইনজীবীদের পেশাটি ব্যবসা নয় সেবা। আদালত এবং আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা। একটা ডানা ছাড়া অন্যটা অচল। তাই বিচারকদের কাজে আইনজীবীদেরকেই সহযোগিতা করতে হবে, তা না হলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল থেকে বিচার প্রার্থীরা সাথে আইনজীবী, বিচারক সবাই বঞ্চিত হবেন। বিচারক তার বিচারকার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। কারণ একজন বিচারক নিজেকে স্বাধীন ভাবলে তবেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব ।
এ প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ তাঁর বিচারিক কর্মজীবনের শেষ দিনে বলেছিলেন – “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে কলমে নিরঙ্কুশ ভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তার মননে, চলনে, বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত।”