“উকিল তুই মিথ্যুক!!”
আইন পেশার মানুষ এই কথাটা একটু ভদ্রোচিত ভাষায় শুনতে ত্যক্ত বিরক্ত, এ বিরক্তি নিয়ে আইনে পড়ুয়া ছাত্ররা পড়েন মহা জ্বালায়, তারা না নিজে বোঝেন, না পারেন অন্যদের বুঝাতে, আবার অনেক আইনজীবীও এই বিব্রতকর কথাটি এড়িয়েই যেতেই পছন্দ করেন।
বাস্তব কথা হল এই, আমাদের আমজনতার আইনি ধারনার প্রধান উৎস হল সিনেমা বা ড্রামা, সেখানে অট্টহাসিতে ফেটে পড়া কুখ্যাত ভিলেনের এক চামচা থাকে, যার দেহে কালো কোর্ট আর আদালতের ভেতর চাটুকারি কথায় দর্শক বুঝেই নেন তিনি এক উকিল এবং তার প্রধান কাজ হচ্ছে মিথ্যে কথা বলা। ছলে বলে কলে এবং কৌশলে সে তার বসকে (ভিলেন) রক্ষা করবেন এবং কারণে অকারণে ভিলেনের চড় থাপ্পড়ও হজম করবে।
যাই হোক এবার সিনেমা হতে একটু বাস্তবতায় অবতারণ করা যাক, এই বাস্তবতাকে আবার ক্লাস ফাইভের বাচ্চাদের মত করে দেখলে হবে না, দেখতে হবে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মত। যার কিনা বাস্তবিক জ্ঞান আছে, এবং ঐ বাংলা সিনেমা বা আদালত নামক ড্রামা একটু দুরে বিনোদনের জন্য সরিয়ে রাখতে হবে। বাস্তবতায় কোর্টের প্রথম চিত্র হবে উকিলে পিছে মানুষ ঘুরবে, এবার তিনি যেই হোক না কেন। আর যদি কোন উকিল কোন মানুষের পিছে ঘোরে ধরে নিবেন তিনি হয় উকিল হতে পারেন নাই নয় তো মানুষ হতে পারেন নাই।
এটা বাইরের চিত্র, এবার ভেতরে আশা যাক। মানুষ উকিলকে মিথ্যুক বলে কারণ তাদের ধারণ উকিলরা কোর্টে সুধু বলে বেড়ান “আমার মক্কেল নির্দোষ” কিন্তু আসলেই কি তাই!?
আসুন একটি সহজ উদাহরণের সাহায্যে বুঝি। করিম পুলিশের কাছে গেল এবং বলল, রহিম তাকে ছুরিকাঘাত করেছে, এবার সরকার (পুলিশ) বাদী হয়ে মামলা করলো, ফলাফলে রহিমকে পুলিশ গ্রেফতার করলো তারপর কোর্ট চালান করলো।
চলুন অংকের মত ধরি, মি. আদনান এই খারাপ লোক “রহিমের” উকিল। এখন সহজ ভাবে দেখলে বলাই জেতে পারে ” বদ উকিল আদনান” কিন্তু বিষয়টা কি সত্যি এতো সহজ? আসুন আবারো ধরি, রহিম এবং করিমের পারিবারিক শত্রুতা আছে, এখনে সেটা বাইরে থেকে কোন ভদ্রলোক কিভাবে বুঝবে? হতেও তো পারে করিম নিজেই তার ক্ষতি করে রহিমকে জেলে ঢুকাতে চাচ্ছে। আবার ধরুন, বিড়ি টানা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে এবং করিম রহিমকে এর ফলে বাঁশ দিয়ে উদম পিটায়, রহিমও এ সময়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হাতের কাছে দোকানের ছুড়িটা পেটে তা চালিয়ে দেয়। এখন জজ সাহেব অনেক কিছু জানলেও জানেন না ঘটনাটা আসলে কি ঘটেছিল। দেখুন, এখানে ঘটনা যাই ঘটুক রহিম মিয়া এবং করিম মিয়ার পরিবারের কাছে তারা কিন্তু নির্দোষ। অতএব ঘটনা যাই ঘটুক একজন উকিল কিন্তু খারাপ এবং মিথ্যুক । স্বাভাবিক ভাবেই তাই এক পক্ষ উকিলের নামে অপর পক্ষ মধুর কথা বলবে না কিন্তু উকিলের কি দোষ? যাই হোক আমাদের এই আপসোস করতে থাকলে চলবে আসুন পরবর্তী পয়েন্টে যাই।
আবারো বাংলা সিনেমার রেফারেন্স টানি, সেখানে ক্ষুব্ধ খলনায়ক মিষ্টি হাসে আর নায়িকা তার সতীত্ব হারানোর বর্ণনা দেয়। ভাই থামেন। কোর্টে এমন হয় না। অভিযুক্ত সাধারণত খাঁচা বন্দি হয়ে হাত জোর করে থাকে (যদিও এমন কোথাও বলা নাই) আর যে কোন সাক্ষী যা ইচ্ছে তা বলতে পারেন না, কেবল মাত্র উকিলে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।
সাক্ষ্য প্রমাণের কথা যেহেতু এসেই গেল একটু বুঝিয়েই বলি। কোন বিষয় (যে বিষয়টি জানা জরুরি) দুটি মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় ( this is a part of question of Fact)
১. দালিলিক প্রমাণ
২. মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ
এখন আমাদের উপরোক্ত ঘটনা কি ঘটেছিল, সে বিষয়ে পুলিশ একটি রিপোর্ট লিখিত আকারে দেবে, যা কিনা দালিলিক প্রমাণ আবার যারা উপস্থিত ছিল তারাও মৌখিক সাক্ষ্য দিতে পারে। তবে নিয়ম হল যেটা সুধু দালিলিক প্রমাণের উপর নির্ভর করবে সেখানে মৌখিক সাক্ষ্য দেওয়া যাবে না, তাহলে বুঝতেই পারছেন, “কা – গ – জ “কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মজার বিষয় হল এই কাগজ গুলো আসে পুলিশ,ডাক্তার, এক্সপার্টদের কাছ থেকে (ড্রামা বা ছিনেমায় ছাড়া উকিলরা কখন এসব বিষয়ে জড়ান না) এখানে উকিল এগুলো দেখে এবং এগুলোর সত্যতা নিরূপণের উপায় সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। (মিথ্যে বলার কোন প্রয়োজন নেই) তাই ভালো উকিলরা তার মক্কেলের কথা শোনেন বটে কিন্তু তাদের প্রধান দৃষ্টি থাকে ঐ দালিলিক প্রমাণে কি লেখা আছে তার উপর। এই দালিলিক প্রমাণ খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সাক্ষীকে (মৌখিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে) এলোমেলো করে তার যোগ্যতা নষ্ট করে দেওয়া তুলনা মূলক ভাবে সহজ। সিনেমা নটকের মত বাস্তবে সাক্ষী ডায়লগবাজি করেন না, সুধু মাত্র যা বলতে বলা হয়েছে তাই বলেন ও প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্যদিকে উকিল সাহেবও সব ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন না এবং প্রাপ্ত তথ্য শেষ লড়াইয়ের জন্য রেখে দেন (Argument – সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে যুক্তি তর্ক) সঙ্গে সঙ্গ সব হাতিয়ার ব্যবহার করেন না, তাই কথায় কথায় আমার মক্কেল নির্দোষ একটি সিনেমাটিক কল্পনা মাত্র।
এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে, আইন একটি বিচার করতে গেলে দুটি জিনিস দেখে
১. Question of Fact (প্রকৃত অবস্থায় কি ঘটেছিল, (এ সম্পর্কে উপরে বলা হয়েছে))
2. Question of Law ( আইন সম্মত ভাবে কি বিচার হয় / আইন ঐ ঘটনা সম্পর্কে কি বলে )
এখন আমার যদি Quesiton of Law এর সমাধান করতে যাই তখন আসলে সত্য মিথ্যার প্রশ্নই আসে না, এখানে আসে আইন কি বলে, একটু বুঝিয়েই বলি, উপরের কেইসে, ধরুন এটা প্রমাণ হল যে “বিড়ি টানা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বোঝে এবং করিম রহিমকে এর ফলে বাঁশ দিয়ে উদম পিটায়, রহিমও এ সময়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হাতের কাছে দোকানের ছুড়িটা পেয়ে তা চালিয়ে দেয়।” এখানে আইন বলছে, যে রহিম তার আত্মরক্ষার জন্য ছুড়ি ব্যবহার করতেই পারে। তার মানে সে কোন অপরাধ করে নি। এখন এখানে এই সহজ আইনের কথা অনেক সাধারণ মানুষ বুঝবে না এবং বলবে উকিল মিথ্যে বলেছে, কিন্তু এই সহজ বিষয়টা আরো জটিল করা যায় কেইস রেফারেন্স দিয়ে (কিছু একই ধরনের অতীত কেইসের উদাহরণ) যে আসলেই কতটা আঘাত করলে তার এমন আত্মরক্ষা করা উচিৎ বলে আইন মনে করে। অথবা আসলেই আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছিল কিনা? মজার বিষয় হোল ভালো উকিলদের আসলে এই Quesiton of Law য়ের জন্যই এতটা নাম, এবং উচ্চ আদালত শুধুমাত্র Quesiton of Law নিয়েই কাজ করে। বলা হয় “যেটা লেখা আছে সেটা আইন না, আইন হোল আদালত যা বোঝেন” এবং আদালতকে কি বুঝবেন তা নির্ভর করে এই মিথ্যুক উকিলদের উপর যেখানে তাদের মিথ্যে বলার প্রয়োজন-ই নেই। মজার কথা হোল আপনি এমন কোন কেইস দেখাতে পারবেন না যেখানে সুধু উকিলের মিথ্যের জোড়ে ক্লাইন্ট বেচে গেছে বরং উকিলের সনদ যাওয়ার ঘটনা পেতে পারেন বড়জোর।
স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ (এমন কি আইনের ছাত্ররাও) Quesiton of Law ঠিকমত বুঝে উঠতে পারে না। এবং এই না বোঝার কারণে তাদের ধারনা, আইনজীবীদের প্রধান কাজ, মিথ্যে কথা বলা।
আশা করি এবার একটু বুঝতে পারবেন, উকিল ব্যটা মিথ্যে বেচে না বেচে জ্ঞান আর মেধা।
ধন্যবাদ।