চেক ডিজঅনার মামলা করতে “চুক্তি” করার প্রয়োজন নেই

আমরা যারা আইন নিয়ে কাজ করি বা যারা ব্যাংকিং সেক্টরে আছি সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অনেক গুলো নিউজ-পেপার, অনলাইনে দেখতে পেলাম যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট চেক ডিসঅনার নিয়ে একটি রায় দিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, চেক ডিজঅনারের মামলা করতে হলে বৈধ চুক্তি থাকতে হবে!

আইনের মানুষ হিসেবে যখন এই বিষয়টি আমাদের সামনে আসে আমরা সবাই একটু অবাক হই এবং স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের জেনারেল সেন্স কাজ করে, কারণ যদি এই রায় সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের যেই “হস্তান্তরযোগ্য” ধরন এবং যার উপর নির্ভর করে আইনটি তৈরি করা হয়েছে সেই মূল বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জের মুখে পরে যায়। কিন্তু যেহেতু আমরা বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায়টি দিয়েছে তাই এ বিষয়টি নিয়ে আরেকটু পড়া দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম। মজার বিষয় হল আমি যখন এই  এই সাম্প্রতিক রায়টি পড়লাম এবং এই রায় যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে সেটা বুঝলাম তখন দেখলাম আসলে এই রায় এ এমন কিছু বলার নেই যে একটি চেকের মামলা করতে হলে তার জন্য কোন চুক্তি থাকতে হবে 

এখন প্রশ্ন করতে পারেন “তাহলে সবাই ভুল লিখেছে?” আমি বলব হ্যাঁ, ভুল লিখেছে বা ভুল বুঝেছে এবং এটা বুঝতে হলে আপনার হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের জায়গাটা আপনাকে ভালো করে বুঝতে হবে, আপনাকে সাক্ষ্য আইন ভালো করে বুঝতে হবে এবং তারপর আপনাকে এই নতুন রায়টি পড়তে হবে এবং এর সঙ্গে আরও কিছু রায়ের উপর আপনার দৃষ্টি আরোপ করতে হবে। এবং সবকিছু একসাথে নিয়ে যখন আপনি তুলনামূলক ভাবে পড়বেন এবং আলোচনা করবেন কেবলমাত্র তখনই পুরো চিত্রটা আপনার সামনে আসবে।

তখন চুক্তির কথাটা কেন আসলো সেই প্রশ্নটা আসলে অনেকের মাথায় আসবে। আমরা জানি চুক্তির বেশকিছু উপাদান থাকে তার মধ্যে একটি হচ্ছে কনসিডারেসন বা বিবেচনা এবং এই রায় আসলে কনসিডারেসন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে সরাসরি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি এবং যেহেতু অনেকেই সম্পূর্ণ আইনটি সঠিকভাবে পড়ে তুলনা করে তারপর রায়টি নিয়ে চিন্তা করেননি এবং তুলনা করেন নি তাই তারা এই দুটোর মধ্যে কনফিউশন করে ফেলেছেন এবং দেখা যায় যে তারা ভুল বুঝে সেটাকে বারবার “বৈধ চুক্তি” নামে আখ্যায়িত করেছেন।

চেক ডিজঅনারের মামলা করার জন্য বৈধ চুক্তি বা চুক্তির প্রয়োজন নেই

যদি প্রশ্ন থাকে যে চেক ডিজঅনারের মামলা করার জন্য বৈধ চুক্তি বা চুক্তির প্রয়োজন আছে কিনা এবং আমরা যদি এক কথায় সাধারণ মানুষের জন্য উত্তর প্রদান করতে চাই তাহলে উত্তরটি হবে, চেক ডিজঅনারের মামলা করার জন্য চেক এর পাশাপাশি অন্য কোন দলিল অথবা চুক্তির প্রয়োজন নেই। 

কিন্তু আপনি যখন একজনের একজন শিক্ষানবিশ অথবা একজন আইনের ছাত্র হন তখন কিন্তু আপনাকে বিষয়টা আরও একটু তলিয়ে দেখতে হবে এবং আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আপনাকে বুঝতে হবে।

আপনি যদি চেক নিয়ে একজন ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন এবং  আপনার চেকটি পাওয়ার পেছনে কোন  কারণ থেকে থাকে তবে আপনি নিশ্চিন্তে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বাকি বিষয়টা বিজ্ঞ আইনজীবী বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

আর আপনি যদি একজন আইনের মানুষ হয়ে থাকে এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণভাবে পড়বেন এবং এর সাথে সাথে আমাদের ইংরেজি আর্টিকেল পড়বেন। “Valid contract” is not a prerequisite for Cheque Dishonour case যেখানে আরও বিস্তারিত ও রেফারেন্স সহ বিষয়টি বুঝানো হয়েছে।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল কি?

হস্তান্তরযোগ্য দলিল হচ্ছে এমন একটা দলিল এমন একটা ডকুমেন্ট যেটা আপনি খুব সহজে একজনের কাছ থেকে আরেকজন কে প্রদান করতে পারেন এবং যার মাধ্যমে একজনের উপর কিছু দায় তৈরি হয়  এবং সেই দায়টা একটা সময় পরিশোধ করতে হয়।  এই হস্তান্তরযোগ্য দলিল কিছু টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করি।

ধরুন, আপনি আপনার বাসার নিচের দোকান থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে কোন একটা পণ্য কিনলেন এবং দোকানিকে ৫০০ টাকা দিলেন, তার কাছে ২০০ টাকা খুচরো নেই, তিনি আপনাকে ২০০ টাকা বিকালে এসে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল এবং আপনিও তাতে রাজি হলেন। তখন আপনাকে দোকানদার তার রশিদের লিখে দিলে যে “২০০ টাকা পাইবেন” এবং নিচে সই দিয়ে দিল। এখন এখানে একটা দায়ের উদ্ভব হয়েছে এবং এই দায়ের এর পেছনে কিন্তু কিছু কারণ আছে। এখন ধরেন আপনি নিজে বিকেলবেলা টাকাটা নিতে না আসে আপনার ছোট ভাইকে সেই কাগজটা দিয়ে দোকানদারের কাছে পাঠালেন এবং দোকানদার কাগজটা দেখে চিনতে পারো এবং তাকে টাকাটা প্রদান করল।  এখানে দেখুন, আপনি কিন্তু দলিলটা আপনার ছোট ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করেছেন এবং যখন ছোট ভাই দোকানদারের কাছে সেটা আবার প্রদান করল তাদের দায় সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ওই দৃষ্টি নিয়ে আপনার ছোট ভাইকে টাকা প্রদান করল।  এই যে দলিলটা প্রদান করল এটা কি আমরা প্রমিজরি নোট হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি ।

হস্তান্তরযোগ্য দলিলের বিষয়টা আসলে উপর উদাহরণ এর মত যেখানে একটি দলিল তৈরি হবে যার পেছনে কিছু কারণ থাকবে, দায় থাকবে এবং যা আপনি সহজে একজনের কাছ থেকে অন্য একজনকে প্রদান করতে পারবেন অর্থাৎ হস্তান্তর করতে পারবেন।  এই হচ্ছে হস্তান্তরযোগ্য দলিলের মূল ধর্ম।

বিবেচনা বা কনসিডারেসন [Consideration]

দুটো বিষয় যখন আমরা সমান বলে বিবেচনা করি এবং একটার বিনিময়ে অন্য একটা আদান প্রদান করে তখন সেটা হয় বিবেচনা বা Consideration।

এখন পুরো ঘটনাটি আবারও একটু লক্ষ করুন এখানে দেখতে পাচ্ছেন যে এই যে 200 টাকার জন্য একটা হস্তান্তরযোগ্য দলিল তৈরি হল এর পেছনে কিন্তু একটা কারণ আছে কিন্তু এই কারণটা হচ্ছে ঐ কাগজের মূল ২০০ টাকার সমান, কারণ সে ২০০ টাকা পায় কিন্তু এটা  কোন চুক্তি নয়,  কেননা চুক্তি হতে হলে আরও বেশ কিছু জিনিসের প্রয়োজন হয় এবং সেটা পরবর্তীতে সম্পাদন করতে হয় কিন্তু এখানে এই বিষয়গুলো বিদ্যমান নয়, এখানে শুধুমাত্র চুক্তির একটা উপাদান আছে যাকে বলা হয় Consideration বা বিবেচনা, এবং ঠিক এই পয়েন্টে আসলে অনেকে কনফিউজড হয়ে যায়।

আমার সামনে আলোচনা করতে গেলে এই কনসিডারেসন এর জিনিসটা বা বিবেচনায় জিনিসটা আবারো চলে আসবেন তাই এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন। এবার আমরা আলোচনা করব চেকের বিষয়।

চেক

চেকের সাধারণ বিষয় জানতে আমাদের আগে প্রকাশিত ইউটিউব ভিডিও এবং লেখাগুলো দেখুন আমরা এখানে শুধুমাত্র চেক,  চুক্তি,  কনসিডারেসন এইসব বিষয় নিয়ে যে কনফিউশন টা আছে তা নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করব তাছাড়া বিস্তৃতভাবে আলোচনা দেখার জন্য বা পড়ার জন্য অবশ্যই আমাদের ইংরেজি লেখাটি দেখুন।

প্রথমেই চলে আসে চেক কি জিনিসটা কি?

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ ধারা ৬ অনুযায়ী খুঁজছে একটা বিল অফ এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় বিল বা হুন্ডি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে বিল অফ এক্সচেঞ্জ এটা আবার কি?  একটি আইনের ধারা ৬ অনুযায়ী  আমরা জানি বিল অফ এক্সচেঞ্জ হচ্ছে একটি বিল বা একটি রশিদ যেখানে একজন মানুষ তার সই দিয়ে অন্য একজনকে একটা আদেশ প্রদান করে যে এই বহনকারীকে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তি কে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রদান করা হোক। সে ওই দলিলটা দিয়ে দিয়ে একজনের কাছ থেকে আগস্টের বিনিময় একটা টাকা পায়। এবং ধারা ৫ এ এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে এই বিনিময়ের বিলের বিষয়টি শর্তহীন হতে হবে। 

এখন আমার প্রথমেই যা দেখতে পাচ্ছি যে চেক এর প্রেক্ষিতে টাকা পাওয়ার জন্য অন্য কোনো শক্ত থাকার প্রয়োজন নেই এবং এটা হচ্ছে খুব সহজেই ব্যাংকে প্রদান করে গ্রহীতা ব্যাংকের কাছ থেকে চেক এর বিনিময়ে টাকা গ্রহণ করতে পারবেন,  সংগঠনের কোথায়ও চুক্তি কথাটি উল্লেখ নেই।

এখন আমরা দেখি যে চেক ডিজঅনার যদি করে ব্যাংক তখন কি নামে আছে।  হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা চেক ডিজঅনার  নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে।

সেখানে বলা হয়েছে একটি চেক ইস্যু করার ছয় মাসের মধ্যে সেটি যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা দিতে হবে এবং জমা দেওয়ার প্রেক্ষিতে এবং জমা দিয়ে সেই টাকাটি বুঝে নিতে হবে। কোন কারণে যদি ব্যাংক সেই টাকাটি প্রদান না করে তবে ব্যাংক চেকটি ডিজঅনার করেছে বলে  আপনাকে একটা রশিদ প্রদান করবেন । 

একজন ব্যক্তি চেকটি ডিজঅনার হওয়ার পরে চেক প্রদানকারীর নিকট এক মাসের মধ্যে একটি নোটিশ প্রদান করবেন এবং তারও এক মাসের মধ্যে যদি অভিযুক্ত টাকাটি প্রদান না করে তবে ভুক্তভোগী নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট বা হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী মামলা করতে পারবেন।  এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্ট টি দেখুন এবং আমাদের ইউটিউব ভিডিওটি দেখুন।

লক্ষ করুন এখানেও কিন্তু কোথাও বলা নেই যে একটি চুক্তি থাকতে হবে বা আদালতে চুক্তি পেশ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখন খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে তাহলে চুক্তির বিষয়ে টা তাহলে কোত্থেকে উদ্ভূত হল অথবা কনসিডারেসন এবং চুক্তির মধ্যে কনফিউশন-ই বা কেন হল?

কনসিডারেসন না থাকে তবে সেই বিষয়টা গ্রহণযোগ্য হবে না: ধারা ৪৩

এর উত্তর সহজে আমরা পাব হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন,  ১৮৮১ এর ৪৩ ধারায়, এই ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন হস্তান্তরযোগ্য দলিলের পেছনে কোন কনসিডারেসন না থাকে তবে সেই বিষয়টা গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ আপনার চেক এর পেছনে যদি কারো না থাকে বা কোন কনসিডারেসন না থাকে তবে সেই জিনিসটি আপনি যদি আদালতে জমা দেন এবং আদালত দেখেন যে এই চেক এর পেছনে বা চেক প্রদান করার পেছনে কোনো কারণ আসলে নেই তখন সে কিন্তু আর সামনে আগাবে না কেসটা সেখানেই ডিসমিস করে দেবে। এখানে লক্ষণীয় যে ব্যাপারটা আছে সেটা হচ্ছে কনসিডারেসন এবং চুক্তি কিন্তু এক নয়।

সাক্ষ্য-প্রমাণ  ও প্রমাণের দায়ভার: ধারা ১১৮

মজার বিষয় হচ্ছে বিষয়ে টা এখানেই শেষ নয়, আমরা জানি যে কোন একটা কেস প্রমাণ করতে হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সেই ট্রাকের প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হয়। এ যুক্তিতর্ক পেশ করবেন এই বিষয়টিকে বলা হয় বার্ডেন অস্ত্র বা প্রমাণ এর দায়ভার। 

সাধারণত যে ব্যক্তি কোন অভিযোগ নিয়ে আদালতে আসেন সে অভিযোগটির পক্ষে প্রমাণ এবং যুক্তি-তর্ক পেশ করেন।  কিন্তু কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই প্রমাণ এর দায়ভার উল্টো হয়ে যায় অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাকেই প্রমাণ করতে হয় যে অভিযোগটি আসলে সত্য নয়।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর ১১৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী যখন কোন ব্যক্তির হাতে একটি চেক থাকবে আদালত ধরে নেবে যে সেটি যথাযথভাবে  বা বৈধভাবে তার হাতে এসেছে তাই প্রমাণের দায়ভারটি উল্টে গিয়ে অভিযুক্তর উপর বর্তাবে যিনি  অভিযুক্ত তার প্রমাণ করতে হবে যে এই চেকটি তিনি তাকে দেননি বা কোন বৈধভাবে চেকটি  তার কাছে যায়নি এবং একমাত্র তখনই তিনি তার দায় থেকে মুক্তি পাবেন।

আপনারা যারা সাধারণত আইন নিয়ে কাজ করেন না তাদের কাছে বিষয়টা একটু খটমটে লাগতে পারে চলুন আমরা সাধারণভাবে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি।

চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট এবং যে চেকের মালিক সে তার সেই চেকটি খুব যত্ন সহকারে রাখবেন এটি আইন ধারণা করে নেয়। যদি চেকটি কোন ভাবে হারিয়ে যায় অথবা কেউ জোর করে চেকে সাইন দিয়ে নিয়ে যায় সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুততার সাথে সেটা পুলিশকে এবং ব্যাংককে জানানো।  যদি কোন ব্যক্তি এই কাজটি না করে থাকেন এবং কেউ চেকের দাবি তোলেন যে একটি আমাকে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে তখন সেই দায় কিন্তু মালিকের বহন করতে হয়। তাই এখানে যেহেতু যদি চেক এর মালিক যথাসময়ে ব্যবস্থা না গ্রহণ করে থাকে তবে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে এই চেকটি যথাযথভাবে প্রাপকের কাছে যায়নি।

প্রশ্ন আসতে পারে এই বিষয়টির সঙ্গে আমাদের চেকের বিষয়টির সঙ্গে স্পষ্ট সংযোগটি আসলে কোথায়?

 

সংক্ষেপে সংযোগটি হচ্ছে এই, আপনি যখন একজন চেক গ্রহীতা এবং আপনার চেকটি যখন ডিজঅনার হবে তখন আপনার শুধু এটা প্রমাণ করলেই হবে যে চেকটি আপনার কাছে আছে  আপনার কোনো চুক্তি কোন দলিল বা অন্য কোন কিছু প্রমাণ করতে হবে না। এখন যদি সেই দাতা বিষয়টি অস্বীকার করে যে, সে চেক আপনাকে দেয়নি তখন তার প্রমাণ করতে হবে যে “না চেকটি আমার কাছ থেকে যত কাছে যথাযথভাবে উনার কাছে যায়নি বা এটা কোন অবৈধ ভাবে তার কাছে গিয়েছে। তাই এটা স্পষ্ট যে আপনার কোন ধরনের চুক্তি প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।

এখন চেকের মালিক দায় মুক্ত হতে হলে দুটো  বিষয় এর যেকোনো একটি প্রমাণ করতে পারে কেবলমাত্র তখন-ই তিনি আপনাকে চেকের টাকা দিতে বাধ্য থাকবেন না বা কোন অপরাধে অভিযুক্ত হবেন না ।

  • ১. যদি সে প্রমাণ করতে পারে যে সে একটি চুরি গিয়েছে একটি হারিয়ে গিয়েছে এবং সে যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অথবা চেকটি অবৈধভাবে  প্রাপকের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে এবং সেই সুযোগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছে।
  • ২.  যদি সে প্রমাণ করতে পারে যে চেকটি কোন একটা কারণে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই কারণটিই যথাযথভাবে সম্পাদন হয়নি তাই সে সেকের টাকাটি প্রদান করেনি, এখানে ধারা ৪৩ অনুযায়ী কনসিডারেসন এর বিষয়টি চলে আসবে এবং সে যদি এটা প্রমাণ করতে পারে কনসিডারেসন অনুযায়ী কাজটি হয়নি তবে সেই থেকে দায় থেকে মুক্ত হবেন।

তাই এটা বলা শ্রেয় যে চেক ডিজঅনারের মামলা করতে বাদীর পক্ষে কোন চুক্তি থাকার প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ, যদি বিবাদী অর্থাৎ চেক প্রদানকারী এটা প্রমাণ করতে চায় যে, চেকটি যথাযথভাবে প্রাপকের কাছে যায়নি তখন তাকে কনসিডারেসন অনুযায়ী কোনো কাজ হয়নি বা কোনো চুক্তি অনুযায়ী কোনো কাজ হয়নি সেটি প্রমাণ করতে হবে।

অন্যদিকে, যদি কোন বৈধ  এবং রেজিস্টার্ড  চুক্তি থাকে তারপরও সেটা বাস্তবায়ন না হয় তখন ধরে নেয়া হবে  কনসিডারেসন অনুযায়ী কাজ হয়নি বা কনফিগারেশনটি কাজে লাগেনি তাই চুক্তি থাকার পরও আদালত সেই চেক ডিজঅনারের মামলা টি ডিসমিস করে দেবেন।

তাই চেক ডিজঅনারের মামলা করতে কোন ধরনের চুক্তি বা এমন কোনো কিছুর এমনকি কোন কাগজেরও দরকার নেই।  তবে অবশ্যই এটা মাথায় রাখতে হবে যে বড় ধরনের কোনো চুক্তি করতে হলে আপনাকে অবশ্যই লিখিত রাখতে হবে।

কেইস: মোঃ: আব্দুল কাহের শাহিন বনাম ইমরান রশিদ এবং অন্যান্য (Md. Abul Kaher Shahin Vs. Emran Rashid and another)

আলোচনা

এতকিছু করার পর আপনাদের অনেকের মনেই হয়তো এখনো কনফিউশনে আছেন, আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে নতুন যে রায় দিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সেটার বিষয়ে তো কিছু বললেন না,  সুপ্রিমকোর্ট চাইলে আইন পরিবর্তন করতে পারে না  বা কোন আইন নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা দিতে পারে আপনি সেটাকে চ্যালেঞ্জ করছেন কিন্তু আপনি সেই রায় সম্পর্কে কিছু বলছেন কে? চলুন এক নজরে বুঝে যাওয়া যাক।

প্রথমত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগ যদি কোন রায় প্রদান করে সেখানে সাধারণত তারা আইনের ব্যাখ্যা নতুন করে দিয়ে থাকেন বা নতুন এঙ্গেল থেকে দিয়ে থাকেন। আমি এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম এই ব্যাখ্যাই আসলে নতুন রায়ে এসেছে এবং এই ব্যাখ্যাটি ওই কেসের যে ঘটনা আছে তার সঙ্গে সংযুক্ত করে বিশ্লেষণ করে প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু আইনের বিষয়টি আমরা মোটামুটি বুঝে গিয়েছি আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট কেস এর ঘটনা টা যদি একটু দেখি এবং রায়টা যদি আমরা দেখি তাহলেই আপনাদের যদি অল্প কিছু কনফিউশন থেকেও থাকে সেটা দূর হয়ে যাবে, চলুন দেখে নেয়া যাক।

সংক্ষিপ্ত ঘটনা

সামছি খানমের থেকে প্রাপ্ত নর্থ গুলশানের ৩০ কাঠা জমি  ইমরান রশিদ চৌধুরী বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন এবং  আবুল কাহের শাহিন নামের এক ব্যক্তি ১৫০ কোটি টাকায় যা বিক্রি করে দিতে পারবেন বলে আশ্বাস দেন, এবং ঐ  আশ্বাসের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ১৩ মার্চ শাহিনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুসারে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বাজারমূল্যে জমিটি বিক্রি করে দেওয়া এবং এ জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শাহিন ১৩ শতাংশ টাকা পাবেন বলা হয়।

ইমরান রশিদ চৌধুরী তখন নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ভবিষ্যতের তারিখ উল্লেখ করে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার ৪ টি চেক আবুল কাহের শাহিন এর নামে ইস্যু করেন। কিন্তু ৯০ দিন পার হওয়ার পরও আবুল কাহের শাহিন বাজার মূল্যে উক্ত জমিটি বিক্রয় করতে অকৃতকার্য হন ফলে সেই চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়।

পরে ২০১২ সালের ১৬ আগস্ট জমিটির ইজারা গ্রহীতা আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে মালিকেরা বায়না চুক্তি করেন এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই বিক্রয় দলিল করেন। অন্যদিকে ইমরান রশিদ চৌধুরী চেক চারটি  ফেরত দিতে  আবুল কাহের শাহিনকে বলেন কিন্তু আবুল কাহের শাহিন পোস্ট ডেটেড চেক চারটি ফেরত না দিয়ে চেক চারটি নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপন করেন।

আইনি প্রশ্ন

এই বিষয়টিই নিম্ন আদালত ঘুরে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে আসে এবং পরবর্তীতে সেটা সুপ্রিমকোর্টের কাছে আসে। এখানে বাদী পক্ষের দাবি ছিল শুধুমাত্র হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন এর 138 ধারা অনুযায়ী  মামলাটির বিচার করা হোক।  অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হোক।

অন্যদিকে বিবাদীর দাবি ছিল যে বিষয়টি শুধুমাত্র হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন এর 138 ধারা অনুযায়ী বিবেচনা করলে চলবে না  বরঞ্চ সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং তাদের আইনি যুক্তিতে ধারা ৬, ৫, ৪৩, ১১৮, ১৩৮ এবং অন্যান্য বেশকিছু  বিষয় তারা তুলে এনেছেন।

পরিশেষে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের অ্যাপেলেট ডিভিশন এই রায় প্রদান করে যে  শুধুমাত্র ১৩৮ ধারা দিয়ে চেক এর বিভিন্ন বিষয়টি বিবেচনা করলে হবেনা সামগ্রিক ভাবে পুরো আইনটিকে নজরে আনতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সকল ধারা কি নিয়ে বিশ্লেষণ করে তবেই রায় প্রদান করতে হবে।  যার প্রেক্ষিতে  যথাযথভাবে বাদীর কাছে  চেক কাছে থাকার পরেও এবং রেজিস্টার চুক্তি থাকার পরেও শুধুমাত্র যে কারণে কনসিডারেসন ধরা হয়েছে সেই কাজটি না হওয়ার কারণে তারা রায়টি পায়না – হেরে যায়। 

চুক্তি বিষয়ে আসলে এই কেসটিতে কিছু বলা হয়নি। এই পুরো কেসটিতে উচ্চ আদালতের আলোচনার  কেন্দ্রবিন্দু ছিল “কনফেডারেশন”  কিন্তু কনসিডারেসন চুক্তির একটা অংশ হওয়াতে এবং কাছাকাছি বিষয় হওয়াতে সেটাকে অনেকে ভুল বুঝেছেন বা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আশাকরি এই আলোচনা আপনাদের কাজে লাগবে।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!