করোনায় মৃত দেহের দাফন/ সৎকারঃ আইন ও বাস্তবতা
নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নামক এই বৈশ্বিক মহামারীতে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে অসংখ্য নাম। এই আর্টিকেল প্রকাশের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৯৭৫ জন। মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন আইনগত সমস্যা এবং অস্বাভাবিক প্রকৃতির প্রশ্ন আমাদের সামনে আসছে, যার মধ্যে অন্যতম হল মৃত ব্যক্তির সুষ্ঠু দাফনের অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন।
মৃত ব্যক্তি করোনা ছাড়ায় না সরকারের এমন ঘোষণা ও যথাযথ স্থানে মৃত দেহ সৎকারের আদেশ থাক সত্ত্বেও, মহামারীজনিত কারণে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের মরদেহ দাফন বা শ্মশানের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় জনগণ কোভিড -১৯ এর আক্রান্তদের নিজ নিজ এলাকায় লাশ দাফনে বিরোধিতা বা প্রতিরোধ করছে। এই ধরনের বিরোধিতা শুধু যে মৃতের পরিবারের সদস্যদের মানসিক যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাই নয়, একইসাথে লংঘিত করছে মৃত ব্যক্তির সম্মানজনক দাফনের আইনী এবং ধর্মীয় অধিকার।
বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে এটি স্বীকৃত হয়েছে যে একটি মৃতদেহ অবশ্যই জীবিত ব্যক্তির মতো একই মর্যাদার আচরণ পাওয়ার অধিকারী। সুতরাং, কোভিড -১৯ এর কারণে যারা মারা যায় তাদের শালীন দাফনের অধিকার নিয়ে কোনও আপস হতে পারে না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে জীবনের অধিকার। এটি একটি বিস্তৃত ধারণা, যার অর্থ কোনও ব্যক্তিকে তার জীবন বা স্বাধীনতা বা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে না, শুধুমাত্র আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বাদে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় দ্বারা এটি স্বীকৃত যে, মৃতব্যক্তিকে শালীনভাবে সমাধিস্থ করাও জীবনের একান্ত অধিকারের সহজাত ও অপরিহার্য অংশ।
কোনও ব্যক্তির মৃতদেহকে শ্মশান বা দাফন এর অধিকারকে সঠিক মানব মর্যাদার অংশ হিসাবে গণ্য করা উচিত।[i] হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) বনাম বাংলাদেশ (রীট পিটিশন নং ৭৭৮৬/২০১২) মামলায় হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পারায় নবজাতকের লাশ পিতামাতার কাছে দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করলে সুপ্রীম কোর্ট রায় দেন যে, মানুষের মৃতদেহ একটি সম্মানজনক দাফনের দাবিদার এবং এটি অবশ্যই একজন মৃত রোগীর বকেয়া পাওনা আদায়ের জন্য নিছক পণ্য হিসাবে ধরা উচিত নয়।[ii]
উল্লেখ্য যে, আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ এবং ভারতের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ একই বিষয় নিয়ে একই মত প্রকাশ করে। এবং আমরা আইনের অনেক বিষয়ে ভারতের আইন ও ভারতে আদালতের রায়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকি এবং অনেক সময় সেগুলোকে ব্যবহার করে থাকি। তাই এই বিষয়ে কিছু ভারতীয় নজির দেখে নেয়া যাক।
১৯৬৩ সালের খারাক সিং বনাম উত্তর প্রদেশ মামলায়[iii] সর্বোচ্চ আদালত ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের জীবনের অধিকারের আওতায় মৃতদেহের অধিকারকেও বিবেচনা করে রায় দিয়েছিল যে, ‘স্থায়ী বা অস্থায়ী যাই হোক না কেন, প্রতিটি মৃতদেহের বঞ্ছনাই অনুচ্ছেদ ২১ এর লংঘন’। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাই কোর্ট একটি মামলায় বলেছেন যে, ‘২১ অনুচ্ছেদের আওতায় আজীবন প্রাপ্ত জীবনের মৌলিক অধিকারের মধ্যে শ্মশান বা শ্মশান দেওয়ার অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’[iv]
তামিলনাড়ু আরো এক ধাপ এগিয়ে এই আইন লঙ্ঘন অর্থাৎ মৃতদেহ সৎকারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যায় এমন ব্যক্তির জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে।[v]
এছাড়াও, প্রথাগত অধিকার হিসাবে দাফনের অধিকারকে বহু রায়তে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে [মোহুন লাল বনাম নূর আহমুয়া (১৮৬৯)[vi]]। এটিও স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়েছে যে, কবর দেওয়ার অধিকার একটি নাগরিক অধিকার এবং সেই অধিকারের সাথে হস্তক্ষেপ নাগরিক অধিকারের উপর আক্রমণ এবং এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।[vii]
সম্প্রতি শ্রীলংকাও করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির দেহ সৎকার বাধ্যতামূলক হিসেবে আইন করেছে।[viii]
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য ‘করোনাভাইরাস আইন, ২০২০’[ix] প্রবর্তন করেছে যা জাতীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ‘জনস্বাস্থ্য (নিয়ন্ত্রণ ও রোগ) আইন, ১৯৮৪’ এর ৪৪ (৩) ধারা উপেক্ষা করার অনুমতি দিয়েছে, অর্থাৎ মৃতদেহ পরিবহন, সংরক্ষণ ও নিষ্পত্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে সরাসরি নির্দেশ করার জন্য বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর মৃতদেহে আর ভাইরাসটির কোন কার্যকারিতা থাকে না। ফলে মৃতদেহ থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর কোন আশঙ্কা নেই। আর এ কারণেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তাকে স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে নিজ ধর্ম মতে সৎকার কিংবা পারিবারিক কবরস্থানেই তাকে দাফন করা যাবে বলে জানায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।[x]
বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তির দাফন সংক্রান্ত বিধান রয়েছে- সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ –এ। এই আইনের ধারা ২০ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন বা করিয়াছেন বলিয়া সন্দেহ হয় তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির মৃতদেহ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর নির্দেশনা মোতাবেক দাফন বা সৎকার করিতে হইবে। একই আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
তাছাড়াও দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ২৯৭ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ কোন ব্যক্তির অনুভূতি, অথবা ধর্মকে আঘাত হানার সম্ভাবনা বা ধর্মীয় অবমাননার সম্ভাবনা, অথবা সহিংসতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন উপাসনার স্থানে অথবা মৃত্যুর জন্য ডিপোজিটরি হিসাবে অথবা কোন মৃতদেহের প্রতি কোনও অপ্রীতিকরতা বা অন্য কোনও কারণে অশান্তি সৃষ্টি করে এমন কোনও অপরাধ সংঘটিত করে অথবা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য একত্রিত ব্যক্তিদের প্রতি কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড, বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারে।
মৃতদেহ দাফন বা সৎকার পরিবার ও জনসাধারণের জন্য খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। এ কাজে যাতে কোন অব্যবস্থাপনা, মতপার্থক্য বা জটিলতার সৃষ্টি না হয় তার জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মৃতদেহ দাফন ও সৎকারের একটি নির্দেশিকা[xi] দেয়া হয়েছে। সেই সাথে সংক্রমণও যাতে ছড়িয়ে না পরে তা রোধ করাটাও এই নির্দেশিকা দেয়ার একটি উদ্দেশ্য। এখানে স্বাস্থ্য বিষয়ক উল্লেখযোগ্য যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে;
- শুধু কোভিড-১৯ রোগী ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ স্পর্শ বা দাফন ও সৎকার করতে হবে।
- মৃতদেহ স্পর্শ নূন্যতম রাখতে হবে।
- কোভিড-১৯ রোগীর মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা যাবে না।
- মৃতদেহ দাফনের আগে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি সুরক্ষা পোশাক পরে এবং জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়া মেনে মুখের লালার নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
- চার সদস্যের একটি দল যথার্থ সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ প্রস্তুত ও বহন করবে।
- অনিয়ন্ত্রিতভাবে মৃতদেহ পরিষ্কার বা ধোয়া যাবে না।
- মৃতদেহ প্লাস্টিকের কভার দিয়ে এমনভাবে মুড়িয়ে রাখতে হবে যেন তা কভারের বাইরের সংস্পর্শে না আসে।
- দাফনের প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করতে হবে।
- মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনো খোলা যাবে না।
- মৃতদেহ অপসারণের পর রোগীর ঘরটি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- এছাড়া মৃতদেহ পরিবহন, পরিবহনে ব্যবহৃত যানবাহন জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
আরো দেখতে পারেন:
Reference
- [i] https://indiankanoon.org/doc/273832
- [ii] http://www.clcbd.org/judgment/search.html?q=rights&Judgment_page=5
- [iii] https://indiankanoon.org/doc/619152
- [iv]https://www.barandbench.com/news/litigation/article-21-includes-right-to-decent-burial-madras-hc-registers-suo-motu-pil-after-mob-obstructs-burial-of-doctor-who-died-from-covid-19
- [v]https://scroll.in/latest/960303/covid-19-tamil-nadu-makes-blocking-funerals-a-crime-offenders-to-face-up-to-three-years-in-prison
- [vi] https://indiankanoon.org/docfragment/303124/?formInput=burial%20right
- [vii] https://indiankanoon.org/docfragment/169324/?formInput=burial%20right
- [viii]https://www.aljazeera.com/news/2020/04/sri-lanka-cremations-compulsory-coronavirus-deaths-200412135710164.html
- [ix] http://www.legislation.gov.uk/ukpga/2020/7/schedule/14/enacted
- [x] https://www.bbc.com/bengali/news-52904294
- [xi] https://dghs.gov.bd/images/docs/Notice/20_03_2020_dead%20body%20handling%20_version.pdf