চুক্তি সম্পাদন কখন করানো যায় ও কখন যায় না | SR 04
আমরা জানি কেউ চুক্তি করলে সেই চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে হয় আর এই কাজটি সঠিক ভাবে করাকে আইনের ভাষায় চুক্তি সম্পাদন বলে, এখন যদি কেউ সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয় বা সম্পাদন করতে না চায় তবে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুসারে তার জন্য [প্রধান] দুটি উপায় খোলা আছে। ১. আদালতের মাধ্যমে চুক্তিটি সম্পাদন করতে বাধ্য করা আর ২. আদালতের মাধ্যমে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করা। কিন্তু দুটি প্রতিকার-ই সবসময় একসাথে পাওয়া সম্ভব হয় না বরং এগুলো কিছু বিষয় ও শর্তের উপর নির্ভর করে আর এই বিষয়ে বিস্তারিত আছে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ও ২১ ধারায়।
এমন সমস্যায় পরলে কোন উপায়টি আপনার জন্য খোলা আছে তা জানতে এই টিউটোরিয়ালটি সম্পূর্ণ পড়ুন এবং বুঝুন।
যেসব চুক্তি বিশেষ ভাবে বাস্তবায়ন যোগ্য
যদি এই অধ্যায়ে (চ্যাপটার II) অন্যকিছু বলা না হয়ে থাকে তবে, আদালতের বিচক্ষনাতায় (Discreation) নিম্নোক্ত বিষয় গুলো বিশেষ ভাবে বাস্তবায়ন করার আদেশ দিতে পারে। তার মানে, চুক্তিটি মানতে এবং চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে আদেশ দিতে পারে। [সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন – ১৮৭৭. ধারা ১২]
- ক. যখন কোন ট্রাষ্টের চুক্তি কিংবা তার অংশ সম্পাদন করার জন্য পক্ষগন সম্মত হয়ে থাকেন।
- খ. যখন সম্মতিত (agreed) হওয়া কোন কাজ না করলে যে ক্ষতি হবে, সেই ক্ষতি সঠিক ভাবে পরিমাপ করার জন্য কোন মান/ মাত্রা থাকে না।
- গ. যখন সম্মতিত (agreed) কাজটি না করলে যে ক্ষতি হবে, সে ক্ষতিটি এমন হয় যে সেই ক্ষতিপূরণ অর্থ (টাকা) বিনিময়ে যথাযথ হবে না।
- ঘ. যখন এমন সম্ভাবনা থকে যে, সম্মতিত (agreed) কাজটি না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না।
যদি উপরোক্ত বিষয়গুলোর বিপরীত প্রমাণ না করা হয়, তবে আদালত ধরে নেবে স্থায়ী সম্পত্তির চুক্তি লঙ্ঘনে যে ক্ষতি হবে তার ক্ষতিপূরণ অর্থের বিনিময়ে সম্ভব নয় এবং তাই আদালত তখন চুক্তি সম্পাদনের আদেশের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করবেন।
ব্যাখ্যা:
ক. ক একটি ট্রাষ্টের নির্দিষ্ট অংশ অবৈধ ভাবে ধরে রাখে যা খ’য়ের অংশ, এই ধারা ১২(ক) অনুসারে, খ ক’কে ঐ অংশটুকু দিতে বাধ্য করতে পারে।
খ. এ বি’য়ের সাথে এক মৃত শিল্পীর একটি ছবি ও দুটি দুর্লভ ফুলদানি বিক্রির চুক্তি করল, এ বি’কে এই ধারার আওতায় চুক্তিটি সম্পাদন করতে বাধ্য করতে পারে।
গ. একটি রেলওয়ে কোম্পানি জেড এর সাথে চুক্তি করলো তার জমির মধ্য দিয়ে তাদের রেল লাইন যাবে এবং তারা জেড’য়ের জমি দুটো সংযুক্ত করার জন্য একটি সুরক্ষিত পথ (archway), তারের বেড়া এবং ঘাট তৈরি করে দেবে, এখানে রেলওয়ে কোম্পানি যদি চুক্তিটি সম্পাদন করতে না চায় তবে তাদের এই ধারা দিয়ে বাধ্য করার যাবে, কারণ বিষয়টি এমন যে, কাজটি না করলে যে ক্ষতি হবে, সে ক্ষতিটি এমন হয় যে সেই ক্ষতিপূরণ অর্থ (টাকা) বিনিময়ে যথাযথ হবে না। কারণ জেডে’র পক্ষে সুরক্ষিত পথ (archway), তার বেড়া এবং ঘাট তৈরি করা সম্ভব নয়।
ঘ. ক, খ’কে সই না করে একটি কর্জপত্র (promissory note) দিয়েছে, ক কিছুদিন পরে দেউলিয়া হয়ে যায় এবং গ ক’য়ের অধিকার প্রাপ্ত প্রতিনিধি (assignee) হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এখন খ গ’কে ঐ কর্জপত্রে সই দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পারে।
এখানে ক সম্মত হয়েছিল কিন্তু সই দেয়নি, পরে সেই সই দেয়ার অধিকার গ’য়ের কাছে এসে পরে (এখানে গ’য়ের কাজ = ক’য়ের কাজ ধরা হবে)। এখন এখানে এমন সম্ভাবনা হয়েছে যে, সম্মতিত (agreed) কাজটি না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না। তাই আগে সই করাতে হবে এবং তা এই ধারা (ঘ) মাতে করানো যাবে।
যেসব চুক্তি সুনির্দিষ্ট বিশেষ ভাবে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়
কিছু চুক্তির এমন ধরন থাকে বা এমন অবস্থা থাকে যখন চুক্তিটি সম্পাদন যোগ্য থাকে না বা সেটা সঠিক ভাবে দেখ ভাল করা যায় না এমন বিশেষ অবস্থায় আদালত বিশেষ ভাবে বাস্তবায়নের আদেশ প্রদান করে না বরং ক্ষতিপূরণ বা অন্য কোন বিকল্প আদেশ দেয়। নিচে বিষয় গুলো ভেঙ্গে বিস্তারিত বুঝানো হোল।
ক) যেখানে চুক্তি ভঙ্গ হলে অর্থ দ্বারা ক্ষতিপূরণ সম্ভব
ব্যাখ্যা: ক খ’য়ের সাথে ১০০ মন চাল বিক্রি করার চুক্তি করেছে, খ সেই চুক্তি সম্পাদনের জন্য আদলতে মামলা করলে আদালত মনে করেন যে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে যথার্থ বিচার করা যেতে পারে, তাই এখানে চুক্তির সম্পাদনার আদেশ দেওয়া উচিৎ নয় তবে চুক্তি ভঙ্গের জন্য বাদী ক্ষতিপূরণ পাবার অনধিকারী, তখন আদালত অবস্থা বুঝে যথাযথ ক্ষতিপূরণের আদেশ দেবেন।
খ) চুক্তির বিশেষ অবস্থা
যদি চুক্তির বিষয় বিষয়টি এমন হয় যে,
- ১. চুক্তিতে অসংখ্য ছোট ছোট বিস্তারিত রয়েছে বা
- ২. যেটা ব্যক্তিগত যোগ্যতার উপর নির্ভর করে বা
- ৩. চুক্তিটি এমন ধরনের, যা লঙ্ঘন হলে আদালতের পক্ষে প্রতিটি বিষয় তত্ত্বাবধায়ন করা সম্ভব হবে না।
ব্যাখ্যা: ক খ’কে জমি চাষ করার করার জন্য ঠিক করে কিন্তু খ করতে অস্বীকার করে, এখানে চুক্তির সাথে খ’য়ের ব্যক্তিগত (চাষের) যোগ্যতার উপর নির্ভর করে তাই এখানে এই চুক্তিটি সুনির্দিষ্ট ভাবে বলবত যোগ্য হবে না।
গ) যেখানে চুক্তির শর্ত গুলো যথাযথ ভাবে বলা থাকে না
ব্যাখ্যা: ক’য়ের একটি ঘর আছে যা সে খ’কে থাকার জন্য আসবাবপত্র সহ গুছিয়ে দেবে বলে চুক্তি করে, পরে ক সেই চুক্তি পালন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এখানে ঘরটি কি কি আসবাবপত্র দিয়ে কিভাবে গুছিয়ে দেবে তা বলা হয়নি অর্থাৎ চুক্তির শর্ত গুলো যথাযথ নয়।
ঘ) যেসব চুক্তি গুলো তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাতিল যোগ্য
ব্যাখ্যা: ক খ’য়ের সাথে একটি অংশীদারিত্বের (Partnership) চুক্তি করল, যেখানে অংশীদারিত্বের মেয়াদের কথা বলা নেই, এখন এই চুক্তি যদি আদালত পালন করতে বাধ্য করে, যে কোন এক পক্ষ যেকোনো সময় অংশীদারিত্বের শেষ (Dissolve) করে দিতে পারে। তাই আদালত এখানে সুনির্দিষ্ট পালন করতে বলবে না।
ঙ) কোন ট্রাষ্টি যদি তার ট্রাষ্ট ভঙ্গ করে বা তার যোগ্যতা থেকে বেশী কোন চুক্তি করে
ব্যাখ্যা: ক একজন ট্রাষ্টি যে একটি জমির দায়িত্বে আছেন এবং ট্রাষ্ট অনুসারে সে ঐ জমি ৭ বছরের বেশি লিজ দিতে পারবেন না। যখন ক খ’য়ের সাথে ৮ বছরের জন্য জমি লিজ দেওয়ার চুক্তি করে তখন তা আর সুনির্দিষ্ট ভাবে বলবত যোগ্য নয়।
চ) কোম্পানির ক্ষমতার বাইরে চুক্তি করলে
বিশেষ ভাবে জনস্বার্থে যদি কোন পাবলিক কোম্পানি বা কর্পোরেশন বা তাদের পক্ষে অন্য কেউ কোন চুক্তি করে যা ঐ কোম্পানির ক্ষমতার বাইরে তখন তা আর সুনির্দিষ্ট ভাবে বলবত যোগ্য হবে না
ব্যাখ্যা: ক একটি কোম্পানি যা কিনা রেলওয়ের কাজ করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুমতি প্রাপ্ত ( কোন কোম্পানি কি কাজ করবে তা কোম্পানির মেমরেন্ডাম অব এসোসিয়েশন এবং মেমরেন্ডাম অব আর্টিকেলে বলা থাকে যার বাইরে কোম্পানি কাজ করতে পারে না।) কিন্তু এই কোম্পানি একটি তুলার মিলের সাথে মিলটি কেনার জন্য চুক্তি করলো। এখন এই চুক্তি যেহেতু তার অনুমতি/ ক্ষমতার বাইরে তাই তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলবত যোগ্য নয়।
ছ) ৩ বছরের অধিক সময়ের চুক্তি
যখন কোন চুক্তি ৩ বছরের অধিক সময়ের জন্য হয় এবং চালিয়ে যেতে হয় (continuous performance)।
ব্যাখ্যা: খ’য়ের জমির উপর ক দ্বারা নির্মিত রেল লাইন ২১ বছরের জন্য ক খ’কে ব্যবহার করতে দেবে বলে চুক্তি করে, সুনির্দিষ্ট শর্তে খ পুরো লাইনের উপর গাড়ি চালাতে পারবে, যেখানে ক, ইঞ্জিন পাওয়ার দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে এবং সংস্কারের কাজও ক করবে, একই চুক্তিটি বিশেষ ভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে না। কারণ এখানে ক কে ২১ বছরের জন্য তার ডিউটি চালিয়ে যেতে হবে।
জ) চুক্তির বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব না থাকলে
কোন চুক্তির বিষয়বস্তু চুক্তি করার আগেই (পক্ষগন সম্মত হওয়া আগেই) তার অস্তিত্ব রইল না।
ব্যাখ্যা: ক এবং খ চুক্তি করলো, যতদিন গ বেচে থাকবে ক খ’কে প্রতি বছর ১০০০ টাকা করে দেবে, কিন্তু পরে জানা গেল চুক্তি হওয়ার আগেই গ মারা গিয়েছেন। যেটা ক বা খ কেউই জানতো না।
- আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন সম্পর্কিত পোষ্টটি দেখুন: সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন (Specific Relief Act) ১৮৭৭; কি এবং কেন? | 01
- সকল বিষয়ের প্রস্তুতি নিতে দেখুন: বার কাউন্সিল পরীক্ষার প্রস্তুতি ২০২০
আমাদের সকল লেখা ও আপডেট পেতে সাবসক্রাইব করুন [ডানদিকে নিচের লাল বেল বাটনটি ক্লিক করুন] অথবা আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে রাখুন।