ভরণপোষণ বা খোরপোষ পাবার আইনি অধিকার

ভরণপোষণ কি?

আভিধানিক অর্থে ভরণপোষণ বলতে বোঝায়, ‘প্রতিপালন করা’। অর্থাৎ, মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের অশ্বিনী কুমার সিনহা বনাম রশনি সিনহা মামলার রায়ে ভরণপোষণ বলতে –  খাদ্য, বস্ত্র, আবাস, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য খরচকে বোঝানো হয়েছে। এছাড়া, শিক্ষার খরচ, শারীরিক ও মানসিক পুষ্টির জন্যে যাবতীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এই ভরণপোষণের জন্য সন্তান নির্ভর করে বাবা-মায়ের উপর, স্ত্রী (সাধারণত) তার স্বামীর উপর, বয়স্ক বাবা-মা তাদের স্বাবলম্বী সন্তান এর উপর। কিন্তু সবাই যে আন্তরিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তা নয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি তার দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবুও আইনের মাধ্যমে সে বাধ্য তার উপর নির্ভরশীল মানুষদের ভরণপোষণ দিতে।

ভরণপোষণ বা খোরপোষ পাবার আইনি অধিকার

ভরণপোষণ বা খোরপোষ পাবার আইনি অধিকার

ভরণপোষণ কারা পায়?

সাধারণত, চার ধরনের মানুষ ভরণপোষণ এর দাবিদার:
• বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে,
• স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে,
• নাবালক পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যা বাবার কাছ থেকে,
• বিধবা পুত্রবধূ শ্বশুর এর কাছ থেকে খোরপোশ পেতে পারেন (শর্তসাপেক্ষে)।

তবে কে ভরণপোষণ পাওয়ার যোগ্য তা বিচার করবে আদালত, কারণ আইন অনুযায়ী, আর্থিক দিক থেকে যারা সক্ষম তাঁরা দুর্বল বা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষটিকে ভরণপোষণ দেবেন। যেহেতু আমাদের দেশে এ বিষয়ে অভিন্ন দেওয়ানি আইন নেই, সেহেতু ভরণপোষণের মামলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পারিবারিক আইনের আওতাতেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পারিবারিক সমস্যাগুলির বিচার করে দেওয়ানি আদালত। বাংলাদেশে ভরণপোষণের জন্য যেসব আইন আছে সেগুলি হল: মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, হিন্দু দত্তক গ্রহণ এবং ভরণপোষণ আইন ১৯৫৬, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩।

মুসলিম স্ত্রীর ভরণপোষণ অধিকার:

মুসলিম বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। বিয়ের পর ভরণপোষণ হচ্ছে স্বামীর জন্য দায়িত্ব এবং স্ত্রীর জন্য অধিকার। স্বামীর আর্থিক সচ্ছলতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাতে স্ত্রীর অধিকারে কোন প্রকার প্রভাব পড়বে না। মুসলিম পারিবারিক আইনে স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, এই অধিকারটি পেতে হলে স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর সাথে বসবাস করতে হবে। আইনের বিধান মতে কিছু ক্ষেত্রে স্বামীর কাছে স্ত্রীরা ভরণ-পোষণের দাবিদার হবে না, যেমন: স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে অস্বীকার করেন এবং স্বামীর প্রতি অনুগত না থাকেন; স্বামীর মৃত্যুকালে ইদ্দত পালনকালে বিধবা ভরণ-পোষণ পাবেন না। তবে স্ত্রী যদি অন্ত:সত্ত্বা হন সেক্ষেত্রে সন্তান জন্ম নেয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণ পাবেন। স্ত্রী যদি ব্যভিচারী হন তাহলেও ভরণপোষণ পাবেন না।

হিন্দু স্ত্রীর ভরণপোষণ অধিকার:

১৯৫৬ সনের বিবাহিতা হিন্দু মহিলার পৃথক বাস ও ভরণপোষণের অধিকার আইন এর ১৮ ধারা অনুযায়ী, স্ত্রী তার জীবনকালে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। তবে, ১৯ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী কতিপয় ক্ষেত্রে আলাদা বসবাস করলেও স্বামীর কাছে থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।

বিধানগুলো হচ্ছে:
১। স্বামী যদি দুরারোগ্য কোন ব্যাধিতে দীর্ঘকাল আক্রান্ত থাকে।
২। স্বামী যদি তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং স্বামী গৃহে তার জীবনাশঙ্কার সম্ভাবনা থাকে।
৩। স্বামী যদি স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই তাকে বর্জন করতে চায়।
৪। স্বামী যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।
৫। স্বামী যদি স্ব-গৃহে রক্ষিতা রাখে
৬। স্বামী যদি স্ত্রীর বর্তমানে আবার বিয়ে করে।
৭। এ ধরণের অন্য যেকোনো যৌক্তিক কারণে।
তবে স্ত্রী যদি ধর্মান্তরিত হয় অথবা যদি আইনসংগত কারণ ছাড়াই স্বামীর সাথে স্ত্রীরূপে বসবাসে অনিচ্ছুক হয় তাহলে সে ভরণপোষণ পাবেনা। এই ধারা অনুযায়ী হিন্দু বিধবা পুত্রবধূ তার শ্বশুর এর কাছেও খোরপোশ দাবি করতে পারেন। তবে তা শর্তসাপেক্ষে।

বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে ভরণপোষণ:

যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেই যায় তাহলে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরও স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। তবে এটি একটি সীমিত অধিকার এবং সীমাবদ্ধ সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। হিফজুর রহমান বনাম শামসুন নাহার বেগম মামলায় আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন যে, মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে কেবল তিন মাস (৯০ দিন) অর্থাৎ ইদ্দতকালিন সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দিতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৯ ধারায় বলা আছে, স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে স্ত্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে এই বিষয়ে আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া, ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ সব ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য এবং এ আইনের ৫ ধারায় ভরণপোষণ-সংক্রান্ত বিষয়ে বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় সহকারী জজ তথা পারিবারিক আদালতের ওপর। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নির্মল কান্তি দাস বনাম শ্রীমতী বিভা রানী মামলার সিদ্ধান্তে বলেন যে, হিন্দু নারীদের এই আইনের আওতায় প্রতিকার চাইতে কোনো বাধা নেই ।

সন্তানের ভরণপোষণ পাবার অধিকার:

আইনত, সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতার। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা চলাকালীন সন্তান মায়ের কাছে থাকলেও, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবার। মুসলিমদের ক্ষেত্রে ছেলের সাবালক হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণ দেওয়া বাবার দায়িত্ব। একজন হিন্দুর কোন সম্পত্তি থাকুক না থাকুক, সে তার নাবালক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা ও বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন

পিতা-মাতার ভরণপোষণ অধিকার:

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী বৃদ্ধ ও কর্মহীন বাবা-মা তার সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ অধিকার আদায় করতে পারেন। এই আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে বলে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ প্রদান না করলে বা এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে সেই সন্তান অনূর্ধ্ব ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত দেখুন এখানে: পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন – ২০১৩ তে যা আছে।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Aparajita Debnath

অপরাজিতা দেবনাথ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্স এর শিক্ষার্থী। ইমেইলঃ [email protected]

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!