ঘোষণামূলক মামলা; ধারা ৪২ | SR 09

দেওয়ানী আদালতে ঘোষণামূলক মামলা একটি অতি পরিচিত শব্দ, অনেকে এই বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অবহিত নন আবার অনেকেরই ধারণা ঠিক আছে কিন্তু একটি মোকদ্দমা পরিচালনা করার জন্য আরও একটু বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। চলুন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ঘোষণামূলক মোকদ্দমা কি?

সহজ ভাষায়, কোন একটি বিষয়ে যেখানে কোন সমস্যা বা বিরোধ দেখা দিয়েছে বা কোন সমস্যা বা বিরোধ দেখা দেয়ার মত অবস্থা হয়েছে সেখানে  সমস্যা বা বিরোধটি আদালতের সামনে পেশ করে আদালতের বিবেচনায় কোনটি সঠিক তা আদালতের মাধ্যমে নির্ধারণ করে ঘোষণা নেওয়ার জন্য যে মোকদ্দমা করা হয় তাই ঘোষণামূলক মোকদ্দমা। এই ঘোষণার মাধ্যমে সমস্যা বা বিরোধের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা ৪২ ঘোষণামূলক মোকদ্দমার কথা বলা হয়েছে।

 

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা ৪২ অনুসারে

যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির কোন অধিকার [এবং অবস্থা] বা আইনগত পরিচয়কে অস্বীকার করে বা করার চেষ্টা করে তবে ই নিগৃহীত ব্যক্তি যিনি অস্বীকার করেছে বা করার চেষ্টা করেছি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। আদালত তখন বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং তার বিচক্ষণতা ব্যবহার করে ঐ অধিকার, অবস্থা বা পরিচয় নিয়ে ঘোষণা দিতে পারেন। 

এই ঘোষণাটি আদালত দেবেন তার রায়ের মাধ্যমে এবং এর ফলে বিষয়টির সমাধান হবে।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারায় মামলা করলে আদালতের নিকট সুনির্দিষ্ট ভাবে ঘোষণামূলক প্রতিকার চাইতে হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি ঘোষণা ছাড়াও অন্য কোন ভাবে তার প্রতিকার চাইতে পারে এবং সেটা না চেয়ে ঘোষণামূলক প্রতিকার চায় তবে আদালত এই আইনে ঘোষণার মাধ্যমে সেই প্রতিকার প্রদান করবেন না।

 

আনুষঙ্গিক প্রতিকার

এই আইনে আনুষঙ্গিক প্রতিকার (Consequential relief) চাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি কোন অধিকার ভোগ করতে অন্য কোন অধিকারও পাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে সেটিও এই ঘোষণামূলক মামলার সাথে উল্লেখ করে দিতে হবে।

যেমন ধরুন: কেউ জমির মালিকানা ঘোষণা চাইল কিন্তু আদালত শুধু ঘোষণা দিলে তো কোন লাভ নেই – যদিনা সে সেটি ভোগদখল করতে পারে তাই দখলও ফেরত চাইতে হবে। এখানে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা সাথে একই আইনের ৮ ধারাতেও প্রতিকার চাইতে হবে।

 

আইনগত অধিকার ও আইনগত পরিচয়

  • প্রসঙ্গত, এখানে আইনগত অধিকার বলতে বোঝাচ্ছে, আইনে প্রদত্ত কোন অধিকার। যেমন, জমির মালিকের জমি-জমা ভোগ দখলের অধিকার। এবং
  • আইনগত পরিচয় বলতে বোঝাচ্ছে, ব্যক্তিগত যোগ্যতার ভিত্তিতে যে আইনগত পরিচয় লাভ করে, এটা ব্যক্তিগত আইন দ্বারাও নির্ধারিত হতে পারে আবার অন্য যেকোনো আইন দ্বারাও হতে পারে। যেমন, স্ত্রী বা সন্তান এবং সমিতির সভাপতির পরিচয় নির্ধারন ইত্যাদি।

 

বিচক্ষণতা

এই ধারার জন্য আদালতের বিচক্ষণতা (Discretion) খুব গুরুত্বপূর্ণ, এই ধারার অধীনে কেউ ঘোষণা চাইলে এবং আদালত বিষয়টা বিবেচনায় নিলে আদালত প্রচলিত আইনের সাথে সাথে তার বিচার বিবেচনাও ব্যবহার করবেন। তিনি শক্ত পোক্ত কোন নিয়মে বাধা নন যে এ বিষয়ে কি রায় দিতে হবে। তবে, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী আদালতের সুবিবেচনামূলক ক্ষমতা সুষম, যুক্তিযুক্ত এবং বিচার কার্যাবলীর মূলনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

ঘোষণামূলক মামলা

ঘোষণামূলক মামলা

চলুন একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেই

ধরুন, রহিম – করিমের ১২ শতাংশ জমি দখল করে খতিয়ানে তার নামে করে নিলো এবং করিম সময়মত সেটি সেটেলমেন্ট / ভূমি অফিসে গিয়ে সংশোধন করতে পারল না এর ফলে খতিয়ানে বিষয়টি ভুল নামে লিপিবদ্ধ হল।

এখন এখানে দেখা যায়, 

  • রহিম, করিমের যে মালিক হিসাবে ভোগ দখলের অধিকার তাতে বাধা দিচ্ছে, আবার
  • একই সাথে করিম যে জমির মালিক বা সত্ত্বাধিকারী [আপাত দৃষ্টিতে] তা অস্বীকার করছে।

অতএব, এই বিষয়টিকে সমাধান করার জন্য করিম দেওয়ানী আদালত একটি ঘোষণামূলক মামলা করতে পারে এবং তার প্রেক্ষিতে আদালত তার বিচক্ষণতা ব্যবহার করে একটি ঘোষণার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করে দিতে পারে।

[উল্লেখ্য যে, শুধু খতিয়ানে ভুল থাকলে তা মালিকানাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে না, এটি দখলের প্রমাণ মাত্র, এখানে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য লেখা হয়েছে]

 

মামলা করার পূর্ব শর্ত

ঘোষণামূলক মোকদ্দমা  কারার পূর্বে তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

  • সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বর্তমানে কোন আইনগত অধিকার আছে কিনা?
  • সেই অধিকার কোন ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে কিনা বা কোন ভাবে সেই অধিকারকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা হয়েছে কিনা?
  • একই বিষয়ে তার অন্যকোন সম্পাদন যোগ্য ডিক্রি (Executable decree) আছে কিনা?

যদি প্রথম দুটির উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে এবং তৃতীয়টির উত্তর না হয় তবে তিনি ঘোষণামূলক মোকদ্দমা করতে পারবেন।

তবে এই মামলা করার আগে এটা মনে রাখতে হবে এই মামলা কোন অধিকার নয় বরং বিশেষ সুবিধা মাত্র, তাই এই আইনের মাধ্যমে আপনি নিশ্চিত প্রতিকার নাও পেতে পারেন। তাছাড়া অন্য কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকলে সেটি করাই উত্তম।

 

ঘোষণামূলক মোকদ্দমার কিছু ব্যবহার:

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এই আইন বিশেষ প্রতিকার দেয় চলুন এর কিছু বাস্তবিক প্রয়োগ দেখে নেই।

ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে

যদি এমন হয় যে কোন ব্যক্তি তার সাথে তার বউ বা সন্তানের সম্পর্ক স্বীকার করছে না তবে বিষয়টিকে নির্ণয়  করতে ঘোষণামূলক মামলা করা যায়। এটা একটা আইনগত চরিত্রের প্রশ্ন। বিয়ে ছাড়াও তালাক হয়েছে কিনা ইত্যাদিও এই আইনের অধীনে নির্ণয় ও ঘোষণা চাওয়া যায়।

 

বেনামী কারবার নিয়ে ঘোষণামূলক মামলা

কোন ব্যক্তি যদি প্রকৃত মালিক না হয়েও নিজেকে প্রকৃত মালিক দাবি করে বেনামী কারবার করে এবং প্রকৃত মালিকের আইনগত অধিকার নষ্ট করে বা করার চেষ্টা করে তবে প্রকৃত মালিক ঐ ব্যক্তিকে  বেনামদার ঘোষণার জন্য ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করতে পারে। 

 

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির মালিকানা ঘোষণার জন্য

কোন ব্যক্তি যদি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির যেমন কপিরাইট বা মেধাস্বত্ত্ব, ট্রেড মার্ক, ডিজাইন ইত্যাদি অবৈধ ব্যবহার করে বা নিজের বলে দাবি করে তখন সেই বিষয়টির জন্য ঘোষণামূলক মামলা করা যায়।

 

চাকরি বিষয় ঝামেলায়

সম্পূর্ণ সরকারি নয় বা বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের অধীনে নয় এমন চাকরির ক্ষেত্রে কোন নিয়োগ বা পদ নিয়ে ঝামেলা হলে সেটি সঠিক করার জন্য ঘোষণামূলক মামলা করা যায়। তবে উল্লেখ্য যে, ১৯৮০ সালের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তাদের চাকরির বিষয় বিষয়ে ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করা যাবে না প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে করতে হবে।

 

মোকদ্দমা দায়ের

আপনি যদি ঘোনামূলক মোকদ্দমা করতে চান তবে একজন আইনজীবীর সাহায্য নিয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। মোকদ্দমাটি একটি এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানী আদালতে দায়ের করতে হবে। এই মামলা করার জন্য তামাদির কোন বিশেষ বিধান নেই তবে সাধারণ ভাবে যেখানে তামাদির সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকে সেখানে তামাদি আইনে ১২০ অনুচ্ছেদ অনুসারে তামাদির সময় প্রয়োগ হয়, তাই মোকদ্দমাটি কারণ উদ্ভব হওয়া ৬ বছরের মধ্যে মামলা  দায়ের করতে হবে।

 

ঘোষণামূলক মোকদ্দমার ব্যাপ্তি অনেক বড় তাই স্বল্প কথায় গুছিয়ে সব লেখা দুরূহ  বটে। এই ধারা অধীনে অনেক বিষয় নিয়েই মামলা করা যায় যা এক সাথে বলা সম্ভব নয় তবে আশা করি এই লেখাটি আপনাদের বিষয়টির মূল বিষয় বুঝতে সাহায্য করেছে এবং বাস্তবিক জীবনে আপনাদের কাজে লাগবে। তাছাড়া আপনি যদি মনে করেন এই আইনের অধীনে কোন বিষয়ে আপনি ঘোষণা চান তবে কোন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন।

বন্ধুদের জানান

ল হেল্প বিডি আইনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাধারণ ভাবে আইন নিয়ে আলোচনা করে। আইনের আশ্রয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত গবেষণা ও কৌশল প্রয়োগ করেন যার ফলে তা সাধারণ আইনের ব্যতিক্রম হতে পারে, আমাদের লেখা এবং সাধারণ সাহায্য কোন আইনজীবীর বিকল্প নয়। প্রয়োজনে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।

আমাদের সেবা নিতে চাইলে ফর্ম, ই-মেইল [email protected] বা ফেসবুকের ম্যসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

Rayhanul Islam

অ্যাডভোকেট রায়হানুল ইসলাম ল হেল্প বিডির প্রধান লেখক ও সম্পাদক। তার আইন পেশার পাশাপাশি তিনি আইনকে সহযে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। প্রয়োজনে: [email protected] more at lawhelpbd.com/rayhanul-islam

You may also like...

3 Responses

  1. Parvez Anowar says:

    খুবই উপকৃত হলাম অসাধারণ ব্যাখা যা সকলের কাজে আসতে পারে।

  2. I am very happy to read the section 42 act, a good solution is to read it yourself first and then consult a lawyer to get the solution.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দু:খিত এই লেখাটির মেধাসত্ত্ব সংরক্ষিত !!